পোষা ছাগল – গল্প
🌤️ পোষা ছাগল – ছোট গল্প
তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি নামার পূর্বে আকাশে তেমন মেঘ জমে না উঠলেও বৃষ্টি ক্রমে ক্রমে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠেছে। বাহির বাড়ির উঠোন ঘেঁষা রাস্তার উপর একটি ছাগল খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। ছাগলটি দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকার কারণে দিক-বিদিক ছুটাছুটি করলেও কোন নিরাপদ স্থানে যেতে পারছে না। উঠোন ঘেরা ঘরগুলোর বারান্দা থেকে অনেকেই এ দৃশ্য দেখে ব্যথিত হলেও কেউ উদ্ধার করতে এগিয়ে আসছে না।
এমন সময় পাশের বাড়ির দেউড়ি দিয়ে একজন মহিলা দৌড়ে এসে চট করে খুঁটি তুলে নিয়ে ছাগলসহ দৌড় দিল। ছাগলটা সহজেই যেতে চাইল তা নয়, তাই তাকে অনেকটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হল।
পাখির নিজের বাঁধা ঘর যতোই অস্থায়ী হোক না কেন কিংবা পাখি যত দূরেই যাক না কেন, সেই পাখিটি যদি কোন বিপদে পড়ে যায় তাহলে আপন নীড়ের দিকেই ছুটে ফিরে আসে। অবুঝ শিশুটিও যদি কোথাও ব্যাঘাত পেয়ে যায়, সে স্থান থেকেও আপন ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু ছাগলটির গতি দেখে মনে হল, ছাগলটি তার আপন ঘরের দিকে যেতে চায় না।
মহিলার বাবার বাড়ি ভাটি অঞ্চলে। এ এলাকায় বিয়ে হয়ে এসেছে প্রায় দশ বছর আগে। তাদের সংসারে দু’টো মেয়ে রয়েছে। একজনের বয়স সাত, আরেক জনের বয়স সাড়ে তিন। তার স্বামীর নাম আখের; বছরের কিছু সময় দিন মজুর, কিছু সময় বর্গাচাষী। বছর শেষে যে পরিমান আয়(উদ্বৃত্ত) থাকে তা ঠিক শুকনো কাঠ
পৃষ্ঠা-০১
পুড়িয়ে যে যৎসামান্য উত্তপ্ত জল বের হয়, তৎ সামান্য সঞ্চয়।
রহিম বিলি নামের একজন আত্মীয় আছেন। সে বেশ স্বচ্ছল। আগে গরীব ছিলেন। মৌসুমী ব্যবসা করে উন্নতির মুখ দেখেছে। তার আচার আচরণ জলের উপর ভেসে চলা পানার মতো। পুকুরেও যেমন, নদীতেও তেমন মানানসই। পানা সুযোগ পেলেই যেমন তার বিস্তার ঘটায়, ঠিক তেমনই সে বিস্তার/প্রভাব ঘটিয়ে থাকেন।
বিবাহযোগ্য এক মেয়েকে দেখতে এসেছে। তার মেঝ শ্যালককে বিয়ে করানোর উদ্দেশ্যে । এরই এক আলাপচারিতার কোন এক ফাঁকে তিনি জানতে পেলেন এখানে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে।এই খোঁজ খবর নিতে নিতে চলে আসেন আখেরের বাড়িতে। (আখের যদিও রহিম বিলির পূর্ব পরিচিত। কিন্তু দীর্ঘদিন তাদের দেখা-স্বাক্ষাৎ না হওয়ার কারণে ভুলতে বসেছে।)
দুই মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী নিয়ে বেশ সুখী সংসার। কখনও হাত বাড়িয়ে কিছু নিতেও হয় না; আবার দিতেও হয় না। আখের আর আয়মালার ঘর জুড়ে এক তৃপ্তির আচ্ছাদন ছিল। আখের সারাদিন বাহিরে খেটে রোজগার করে আসে; আর আয়মালা তাই দিয়ে নানান হিসেব কষে সংসার চালিয়ে নিয়ে যায়। তাদের সংসারে দৈন্যতা আছে কিন্তু দীনতা নেই।
তখন আয়মালা মেয়েকে শোবার ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রেখে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছে, এমন সময় রহিম বিলি নানান অস্ফুট উচ্চ শব্দ করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। রহিম বিলি যে কোনো পরিবেশেই মানান সই। হাস্যোজ্জ্বল। সাবলীল। আয়মালা রহিম বিলি কে চেনে না। কিন্তু তার সাবলীল ব্যবহারে আয়মালার বুঝতে কোনো বাকি রইলো না যে, সে তার স্বামীর ঘনিষ্ঠ কেই।
পৃষ্ঠা-০২
আয়মালা তাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত বসতে দিল। ঘর থেকে মেয়েকে কোলে নিয়ে স্বামীকে ডেকে ডেকে কলরব করতে করতে বাহিরবাড়ির দিকে তড়িঘড়ি করে ছুটে গেল । রহিম বিলি যে বাড়িতে মেয়ে দেখতে গিয়েছিল, ওই বাড়িরই এক মুরুব্বি আখেরকে রহিম বিলি আসার খবর দিয়েছিলো। আখের সংবাদ পেয়ে জোর কদমে বাড়ির দিকে ফিরে আসে। আখেরকে দেখে আয়মালা স্বস্তি পেল।
রহিম বিলি আখেরের নানিবাড়ির সম্পর্কের পড়শি ভাই লাগে। আখের ছোটবেলায় যখন নানির বাড়ি যেতো, তখন তার সাথে মিলে নানান দুষ্টমিতে নানির বাড়ি যাওয়ার সময়টুকুকে সার্থক করে তুলত। তখন অবশ্য রহিম বিলি অন্য বালকের চেয়ে একটু বেশি-ই দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। এ নিয়ে পাড়া জুড়ে তার বদ-খ্যাতিও রয়েছে। তবে, বর্তমানের কথা আলাদা। বর্তমান সমাজে তার বেশ প্রতিপত্তি আছে; তাই সম্মানও আছে। রহিম বিলি যে এতো কিছু কী করে করলো তা আখেরের মাথায় কুলোয় না। আখের নিজেও ঘাম ঝরায় কিন্তু উন্নতি নাই; আর রহিম বিলি খাটেও বটে আবার ঢের বেশি উন্নতিও ঘটে। করমর্দনে আখের রহিম বিলিকে গ্রহণ করে নিলো। শেষে বুকে জড়ায়ে নিলো।
-ভাবি সাব, এ পীরিত বহু দিনের। ছোটবেলার। কী যে শয়তানি করেছি তখন। এখন তা মনে পড়লে হাসিও পায় আবার লজ্জাও লাগে।
পৃষ্ঠা-০৩
-ছাড়ো তুমি ওসব কথাবার্তা! কেমন আছো, বলো?
-আছি, তোমাদের দোয়ায় ভালো আছি। জীবনে কষ্ট করেছি; উপরওয়ালা শান্তি দিয়েছেন। বেশ ভালো আছি। এক জীবনে দুই জীবন দেখে গেলাম। দুঃখের জীবন আর সুখের।
-তুমি তো ভালোই আছো। জীবনকে ভোগ করলা। শালার জীবন আমার। বেঁচে থাকলাম কিন্তু বাঁচতে পারলাম না।
-চোখ খোলা রাখো। তোমারও হবে।
-থাকুক এ সকল কথা। মেয়ে কেমন দেখলা।
-মেয়ে তো ভালোই। তবে মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নাই। সংসার করতে দাস্তি মেয়ে দরকার আছে, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির(জামাইয়ের) আদরেরও দরকার আছে। এ যুগে বিপদ-আপদ তো আর বলে কয়ে আসে না। তখন হাল ধরার জন্য ঠিক থাকা চাই।
-তা তো আছেই। তবে ঘরে গিয়ে শান্তি বলে একটা কথা আছে। সব পেলা কিন্তু শান্তি পেলা না, তা তো হবে না। মেয়েটা বেশ লক্ষী। দেখতে-শুনতে ভালো। লোক হিসেবেও ভালো। কোনো কিছুরই সাতেও নাই, পাঁচেও নাই।
-ভাই, মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। কোনো দিন জোরে কথা বলতে শুনি নাই। (আয়মালা বলল)
-টাকা থাকলে শান্তি কিনে আনা যায়। থাকুক সে সব কথা। আমি যা দেখেছি আর বুঝেছি, তা শ্বশুরকে বলব। তখন তারা যা করেন।
পৃষ্ঠা-০৪
-বউ, বিলিকে খাবার দাও।
-না ভাবি, মেয়েদের বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।
-তাহলে নারইল-চিড়া দাও। কালকে বউ বানাইছে। অসুস্থ শরীর তবুও বানাইছে। গত সোমবার রাতে স্বপ্নে দেখছিলাম। বউরে আবার সে কথাই বলছিলাম। তাই শুনে কষ্ট করে বানাইছে।
-আমার বউরে বললে, সে তিনখানা ঝাহইর মাইরা উঠতো। আচ্ছা দাও তাইলে। অনেক দিন হলো নারইল-চিড়া খাই না। গ্যাসের সমস্যা আছে; তাই জ্বালাতনের জন্যও খাওয়া হয় না।
একটি স্টিলের বাটিতে করে নারইলচিড়া নিয়ে আসল। সেই সাথে প্লাস্টিকের জগে করে পানি আর শিশার গ্লাস এগিয়ে দিল।
ওদের মাঝে এদিক-ওদিক নানান কথা চলছে। প্রত্যেকের যাপিত জীবন সম্পর্কে এক ধরণের ঘেন্নাবোধ ফোটে উঠছে। মানুষ মূলত নিজের অবস্থান ছেড়ে সব সময়ই ছুটে চলে যেতে চায়। অর্থাৎ, যে জীবন মানুষকে এই প্রকৃতি দিয়েছে, সে রকম জীবন আবার মনের কল্পনার জগতকে দেয়নি। সেই জীবন(কল্পনার জগৎ) আরাম আয়েশের, চাকচিক্যের। তাছাড়া কাছের মানুষগুলোর উন্নতি দেখলে সেই কল্পনার জগতের জীবন আরও স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ধরা পড়তে থাকে। তখন বিকল্প জীবনের সন্ধান না পেয়ে আফসোসের ভাষা ফুটে ওঠে।
-ভাই, এইতো হলো আমাদের সংসার। বর্ষা এলে ছাতা ধরি। আবার বর্ষা শেষে রোদ থেকে বাঁচতে গাছের নিচে আশ্রয় নেই। আর কিছু ফিরাই পিঠ দিয়ে। দুইটা সন্তান নিয়ে সামনের দিনগুলো কেমনে চলবে তা নিয়েই শুধু ভাবি। (স্বামী-কে) কতবার বলি শহরে যাও। নতুন কাম-দেখো। তা কি পাইছে, ঘর ধইর্যা রইস্যা আছে। (অনেকটা ক্ষোভ থেকেই কথাগুলো আয়মলা বলল।)
পৃষ্ঠা-০৫
-বিলি, তুই বল, শিক্ষিত মানুষরাই কাজ পায় না, আর আমি কেমনে কাজ পামু। শহরের লোকজন গতর দেইখ্যা তো আর কাজ দেয় না; মগজ দেইখ্যা দেয়।
-আখের, আমাকে দেখ। ভাবি আমার কথা একবার ভাবেন। আমি কি কারো গোলামি করি? কারও গোলামী না করেও দিব্যি ভালো আছি।
-তুমি তো চালাক মানুষ। সবখানে গিয়ে রোজগার করতে পারো।
-তুইও শিখবি। এই যে পল্লী ব্যাংকের ম্যানেজার, সে কি জন্ম থেকেই কাজ শিখে আসছে? দেখে দেখে শিখছে; চেষ্টা করে শিখেছে। তুইও চেষ্টা করবি। শিখবি।
আখের হেসে বলল- না রে ভাই, আমার শেখার দরকার নাই। এই বেশ আছি। দিন শেষে ঘুমাতে পারলেই হল।
-ভাবি, আপনি শক্ত হোন। এরে দিয়ে হবে না। বিনিয়োগ না করলে লাভ আসে না। উন্নতি হয় না। এক টাকায় কিনবি (আখের কে উদ্দেশ্য করে); আর একটাকা চার আনাতে বেঁচবি। এমন করে দিনে চারটা বেঁচতে পারলে এক টাকা লাভ। এবার মাসে কত টাকা আয়; ভেবে দেখেন ভাবি।
যে হাসি গভীর চিন্তাকে হালকা করে দেয়, সেই রকম হাসি যেন আখেরের মুখ থেকে সরছেই না। কিন্তু আয়মালা, রহিম বিলির কথায় যেন তার লুকায়িত অথচ দানা বাঁধা স্বপ্নকে স্পর্শ করে চলছে। যে পথ আয়মালা হয়ত মনে মনে খুঁজছিলো, তার স্পর্শই সে যেন পেয়েছে। তাই সবকিছুকে ছাপিয়ে রহিম বিলির কথাগুলো তার কাছে দামি হয়ে উঠছিলো।
পৃষ্ঠা-০৬
-ভাবি, আমি একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলি; শুনেন, একদিন ক্ষেতে কাজ শেষ করে ঘরে ফিরেছি মাত্রই। সাথে টাকা ছিল বটে কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। বউ যখন বললো, ছেলে একটা সাইকেল কেনার বায়না ধরেছে; আর এ জন্য ছেলেকে মেরেছে। আমার মাথায় রক্ত চন্ করে উঠল। তখন ভাবলাম, আমার যদি টাকা থাকত তাহলে বউ তো আর ছেলেকে মারতে পারতো না। আমার টাকা থাকলে ছেলের মন ভেঙে যেত না। সব দোষ আমার কাঁধে নিয়ে নিলাম। প্রকৃতপক্ষেই সব দোষই আমার। আমার অক্ষমতার জন্যই এমন হয়েছে। আমি সারা রাত ভাবলাম- কি করা যায়, কি করব? লেখাপড়া জানি না যে অফিসে চাকরি নেব! সে রাতে আমার ঘুম হলো না। তাছাড়া বউ দিয়ে তো ক্ষেত-খামরে কাজ করাতে পারি না, যে দুই জনে মিলে কামাই করবো! দিশেহারা হয়ে পড়লাম। বউ ঘর সামলাবে, আর আমি সামলাবে বাহির! কী করি, এখন কি করা যায়? এমন নানান প্রশ্ন সে রাতকে আমার কাছে দিনের মতো লাগতে আরম্ভ করলো। চোখে কোনো ঘুম নেই।
সকাল হতে না হতেই না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পৃথিবী নিষ্ঠুর, তার ভাণ্ডারে সবকিছুই আছে। কিন্তু আপনা আপনি এর কিছুই(কুক্ষিগত) আসে না। যে যে কেড়ে নিতে পারে সেই এর দখলদার হয়। নাহ! ওই দিন কিছুই খুঁজে পেলাম না। এভাবে ঘোরার পর আবার বাড়ি ফিরে আসি। ঘরের অভাবটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো আমার কাছে।
আমার মনের মাঝে একটা জেদ ছিলোই- আমি যা খোঁজ করছি তার দেখা পাবো-ই। সত্যি বলতে কি, আমি যে জীবন যাপন করছি তার প্রতি আমার একটা ঘেন্না চেপে বসেছে। হয় আমি কিছু করবো, না হয় দু’চোখ যেদিকে যায় সে দিকে চলে যাবো।
পৃষ্ঠা-০৭
পাঁচ দিন পর ক্ষুধার জ্বালা আর সইতে না পেরে এক দোকানীর কাছে একটা কলা চেয়ে নিলাম। ওই লোকটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছু ক্ষণ কি যেন ভাবল। এরপর আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বসিয়ে দুইটা কলা খেতে দিল। সেই সাথে আমার মনের আকুতিটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তিনি তেমন কিছুই বলল না। শুধু বলল- এই চার হালি কলা নাও। দিন শেষে আমাকে ষাট টাকা ফেরৎ দিলেই হবে।
সেদিন তার কথা আমি ফেলতে পারিনি। মনে হলো, তার কথার মূল্য দেওয়া উচিত। সে দিন থেকে আজ অবধি আর কারো কাছে হাত পেতে কিছুই চাইতে হয়নি। বরং মানুষকে দু’হাত ঢেলে দিয়েছি।
আসলে তেমন কিছুই নয়। একটু সাহস, কিছু টাকা, আর সামান্য বুদ্ধি থাকা লাগে। বর্তমানে অনেকেই আমার সাথে পার্টনারে হয়ে ব্যবসা করে থাকে। তাদের টাকা আর আমার বুদ্ধি। লাভ বেশি পেলে কারো তো আর বলার কিছু থাকে না, তাই না?
-ভাই, ঠিক বলেছেন। অনেকেরই টাকা আছে কিন্তু সাহস নাই। আবার সাহস আছে টাকা নাই। এমনও আছে, টাকা ও সাহস দু’টোই নাই। তবে সামনেেএলেই আগানো হয় আর কি।
-ও করে আমাদের কাজ নেই। যেমন আছি তেমনই ভালো। এত বেশি লোভ করে কি হবে!
-লোকটা কখনো উপর দিকে তাকাতে চায় না। সারা জীবন কচু-ঘেঁচু চাষাবাদ করবো নাকি! (আয়মালা কিছুটা খুঁচা দিয়েই বলল।)
-এমন অনেক মানুষ আছে যারা গায়ের ধূলো পর্যন্ত ধুইতে চায় না। মায়া ছাড়ো আখের! পথ খোঁজো…
আখের হেসে বিষয়টা হালকা করে নিল।
অতি স্বাভাবিকভাবে যা পাওয়া যায় তা বোধ করি তুচ্ছ লাগে। তাই প্রশ্ন জাগে– স্বর্ণখনির এলাকায় স্বর্ণের দামই বা কত!
পৃষ্ঠা-০৮
আয়মালার এই যাপিত জীবন হঠাৎ করেই ঘোলাটে হয়ে উঠলো। সে যে কাজ করে তার পেছনে বোধ করে সে সময় টুকু অপচয় করছে। মনে মনে ভাবে, এ সময়টুকু আরও মূল্যবান করতে পারে।
আখেরের শান্তির ঘরটা এক মধুর স্বপ্নের উন্মাদনায় ক্রমে ক্রমে নাভিশ্বাস হয়ে উঠছে।
-আয়মালা, আমরা এই বেশ আছি। কারো কাছে হাত না পেতেও বেশ আছি। লোভটা কিন্তু শয়তান তৈরি করে দেয়। এছাড়া রহিম বিলির মতো আমি নই। ওর মতো সত্য-মিথ্যে এক করার সামর্থ্য আমার নাই।
-তুমি কি ভাবো, সবাই মিথ্যেবাদী?
-তা নয়, তবে ও কাজ আমার দ্বারা হবে না।
-ক্ষেতে ধান লাগানো হলে সে ধান ঘরে উঠবো কি না তা অনিশ্চিত জেনেও তো আবাদ করে থাকি। লসের ঝুঁকি না নিলে লাভের মুখ দেখবে কি করে।
আয়মালার কথায় আখেরের মনে শক্ত দানা বাঁধলো বটে কিন্তু অজানা এক ভয় তা আবার তরল করে দিচ্ছে।
এভাবে আরও কয়েকটা মাস পার হল। কার্তিক মাস শেষ। ধানের কাজ শেষ করে অবসর সময় পার করছে সবাই। এদিক-ওদিক নানান কথার ছলে সেই চাঁপা পড়া কথাটা মাথা চারা দিয়ে উঠল আবার।
-সময় করে না হয় একদিন ঘুরে আসো। ফেলনা জিনিস সময় মত দামি হয়ে ওঠে।
আখের তার স্ত্রীর কথা শুনে কি যেন ভাবলো।
এভাবে আরও এক সপ্তাহ পার হলো। সুখের হাত ছানি ভেলকির মতো মনে হলেও এক সময় তা বাস্তব হয়ে উঠে। আখেরের মনে কেমন যেন একটা কাতর ভাব জন্মালো। সে নিজ থেকে স্থির করলো, একদিন রহিম বিলি’র সাথে দেখা করে আসবে। অবশ্য এ ব্যাপারটা আয়মালার কাছে সম্পূর্ন গোপন রাখতে চেয়েছে।
পৃষ্ঠা-০৯
সেদিন বুধবার ছিল। আখের যখন দীঘলডাঙ্গা বাজারে পৌঁছালো তখন সূর্য ঠিক মাথার উপরে। পাশের এক মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে নিলো। রহিম বিলির ব্যবসায় এই বাজারে। নানান সংকোচের কারণে সে রহিম বিলির বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে চায়নি। সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে একটু অন্যরকম ভাবে সমাজের উঁচুদরের সভ্যতার চোখে দেখে। আখেরের লাজ ঠিক তেমনই।
বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেছে। রহিম বিলি হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় হেঁটে আসছে দেখে আখের কিছুটা এগিয়ে গিয়ে করমর্দন করলো। রহিম বিলি আখেরকে দেখে বেশ খুশি হলো।
-স্বপ্ন মানুষকে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে থাকে– ওহে! (আখেরকে সম্বোধন করে রহিম বিলি বলল)
-ঠিক বলেছো। মাথায় ঘোরপাক খায় শুধু।
-বাড়িতে না গিয়ে এখানে কেন?
আখের ওই এক রকম হেসে হেসে বিষয়টাকে হালকা করে নিলো। রহিম বিলিরও যেন এ নিয়ে কোন তেমন ভাবনা নেই।
দুই জনে বসে এক চা খেলো। এরপর তরুতরকারির খুচরা বাজার পার হয়ে পাইকারি বাজারে প্রবেশ করল। কারও দাদা ভাই, কেউ মিঞাঁ ভাই, কেউ চাচা এমন নানান সম্বোধনে মুখরিত হয়ে উঠলো। যা দেখে আখের বেশ অভিভূত হয়ে উঠল। তার ভেতরে এক রকম পুলক অনুভূব হলো।
বাজার-ঘেঁষা এক কোণার একটি ছোট্ট দোকানে। ওরা দু’জনে গিয়ে বসলো। দুইজনের মাঝে বিস্তারিত আলাপ হলো। আখের স্পষ্ট বুঝতে পারলো যে, রহিম বিলি যে পরিমান পয়সা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলো এখন সে রকম আর পরিস্থিতি নেই। অনেক টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। তাছাড়া হিসেবের খাতায় লাভের অঙ্ক নেহায়েত কম নয়। লোভ তো জাগেই, কিন্তু মনের কোণ জুড়ে জমে থাকা মেঘ ভারি হয়ে উঠছে আবারও।
পৃষ্ঠা-১০
সন্ধ্যা নামার পূর্বেই আখের বিদায় নিয়ে বাজার ছেড়ে চলে এলো। অবশ্য রহিম বিলি বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলো বাড়িতে যাওবার জন্য। কিন্তু না; আখের এখানে এসেছে, সে কথা বাড়িতে বলে আসেনি। তাছাড়া এ কথাগুলো কেউ না জানুক তার প্রতিই তার বিশেষ ঝোঁক ছিল।
বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো। আয়মালা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। যা আপন তা তো আপনই। কিন্তু আপনা গণ্ডি ছাড়িয়ে যে সম্পর্ক প্রাণের হয়ে উঠে, তখন তা নিজের অস্তিত্বের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী-স্ত্রী মাঝে গড়ে উঠে এক মধুর বন্ধন। শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বেড়ে গিয়ে আখের ও আয়মালার মধ্যে প্রাণের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে একটু একটু করে। ফলে পরস্পরের অনুপস্থিতিতে অন্তরের মাঝে পীড়া দিয়ে উঠে। উতল করে উঠে।
-কোথায় ছিলেন? (খানিকটা বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে আয়মালা।)
-আয়মালা, আমাদের যা আছে তাতে আমরা সুখী না?
-তুমি চোখের সামনে থাকলেই খুশি। আর আমার কোন চাওয়া নাই।
-তাহলে ওসব ভাবনাগুলো ছেড়ে দাও। ব্যবসায় আমার দ্বারা হবে না। আশ্বাস আর ধরণা ধরে(প্রতীক্ষা) লাভের জন্য অপেক্ষা করা, এ আমার দ্বারা হবে না।
আয়মালা আর কোন উত্তর দিলো না। শুধু আখেরের পাশ থেকে সরে গেল। পৃথিবীর সবাই জানে আগামীকাল জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে তা অজানা। তবে তাই বলে কি আগামীকাল সূর্য উঠবে না কিংবা পৃথিবী থেমে যাবে! বা পৃথিবী গতিশীল থাকলেও আমি/আমরা থেমে গিয়েছি! তবুও তো আমার/আমাদের সংসারের চাহিদা স্থবির হয়ে যায় না তো! তাই আমাদেরকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মূলধন বাড়াতে হবে/সঞ্চয় করতে হবে পরবর্তী দিন গুলোর জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এটা তো বড় অপচয়, আমি আমার সামর্থ্যের(শক্তি/বুদ্ধি) ব্যবহার করছি না!
অন্যায় তো বটেই।
পৃষ্ঠা-১১
অসন্তুষ্টি নয় বরং আখের কেমন যেন একটা খেই চেপে বসে রইলো। আচ্ছা, মানুষ কি সত্যিই পারে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে? যদি এমনই হতো, তবে কে না চাইতো গরীব হয়ে থাকতে! হ্যাঁ, কোন কিছুই আপনা-আপনি আসে না। পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু সব পরিশ্রমের কি সফলতা পাওয়া যায়/আসে? উন্নতি আসে? পরিবারের সবাই একই পাতিলের ভাত খেয়ে কারও শক্তি বাড়ে আবার কারও শক্তি কমে। জীবন বড় ভেলকির মঞ্চ।
আরও দিন ছয়েক পার হলো। এ নিয়ে আর কোনো কথা-বার্তা হলো না।
সেদিন বিকেলে আয়মালার মা-বাবা এসে হাজির হল। ছেলে-মেয়েরাও নানা-নানি পেয়ে মহা খুশি। কিন্তু খুশি হবার কোন লক্ষণ আখেরের মাঝে প্রকাশ পেলো না। তার স্বাভাবিক ব্যবহার। অনেক মানুষ হয়না এমন, যারা তার শশুড়-শাশুড়ির সাথে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। লাজুক। ঠিক এমন হলো আখেরের, যেন সে কোথায় পালায়। এই দেখে আয়মালার হাসিও পেল আবার বিরক্তও লাগল।
পরের দিন রাতের বেলা।
-বাবা, তুমি তো আর গেলে না।
-মা, আমি সময় করে উঠতে পারি নাই। যাবনি।
-আর কবে যাবে? ছেলে-মেয়ে বড় হলে তখন তো আরও সময় পাবে না।
-জামুনি।
-সময় পায় না; আবার এদিক-ওদিক ঘুরার ঠিকই সময় আছে। বেজায় সময়ের হিসেব তার।(আয়মালা কিছুটা খুঁচা দিয়ে বলল।)
-ঘর সংসারে কাজ করার পর আসলেই সময় পাওয়া যায় না।(শ্বশুর সরল উত্তর দিল।)
-জামাই শ্বশুর একই রকম হইছে। ক্ষেতের কাজ শেষ হলে তারে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু ঘুরে আর গল্পগুজবে ডুবে থাকে।
-তরা মেয়ে মানুষ। তাই কেমনে কি বুঝবি। পুরুষ মানুষের খাওন-পরনের পরও আরও মেলা কাজ থাকে।(শ্বশুর)
-এতো সুন্দর একটা প্রস্তাব দিলো, তার দিকে মাথা পাতলো না। তা শুনলে ঘরও চলতো আবার বাহিরও হতো। (শাশুড়ি আখেরের দিকে তাকিয়ে বলল।)
আখের খেয়াল করলো, শ্বশুরের চেয়ে শাশুড়ির ঝোঁকটা বেশি। অতঃপর শ্বশুর কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
পৃষ্ঠা-১২
-জামাই, ঘটনাটা খুলে বলো তো।
-আব্বা, বিষয়টা নিয়ে আমার যতটা ভালো লাগছে তার চেয়ে বেশি ভয় কাজ করছে। কারণ অন্যের হাতে নিজের টাকা রেখে তা আবার সংগ্রহ করা, আর সেখান থেকে লাভের মুখ দেখা, সত্যিই বেশি পরিমাণে ঝুঁকি হয়ে যায়। তাছাড়া আমার পক্ষে বকাঝকা করে টাকা পয়সা তুলে আনা সম্ভব নয়। আর আমার এতবেশি জমানো টাকাও নাই। যে সামান্য পরিমাণ আছে তা তো আপদ-বিপদের জন্য। তাছাড়া, রহিম বিলি ছোটবেলা থেকেই অনেক চঞ্চল, দুষ্টু প্রকৃতির। ওর সাথে আমার সাজে না।
-তাই বলে তো মানুষ কাজ করা বাদ দিয়ে বসে থাকবে না। তুমি যা ছেড়ে দিতে চাও তা তো কেউ না কেউ করবেই। কারো জন্য কোনো খালি স্থান পুরণ হওয়া বসে থাকবে না। সাহস না দেখালে আগাবে কেমনে? পোলাপাইন বড় হচ্ছে। সেই সাথে দিনের ভাউ-বাজার যে হারে বেড়ে যাচ্ছে! এখন শরীর ভালো আছে। দুই দিন পর শরীর পড়ে যাবে। তখন ?(আয়মালা কথাগুলো বলল।)
-জামাই বাবা, কথাটা শোনো। কালকে কি হবে তা তো আর আজকে বলতে পারবানা। তাই বলে কালকের ভয়ে আজকের দিনটা তো কেউ আর নষ্ট করবে না। আকাশে সূর্য উঠলে বেছে বেছে আলো দেয় না বটে। তবে হ্যাঁ, রোদে কেউ পুড়ে আবার কেউ সতেজ হয়ে উঠে। সাহস করে শুরু করো বাবা।(শাশুড়ি অত্যন্ত ভরসা দিয়ে কথাগুলো বলল।)
-মা, আমিও তাই বলি। নেমে দেখো কেমন হয়! (আয়মাল তার মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল।)
আখেরের শ্বশুরও কিছুটা সম্মতি দিলো এবং দশ হাজার টাকার সহযোগীতাও করতে রাজি হলো। আখের একেবারে যে রাজি ছিল না এমন নয়; তবে আগ্রহী ছিল এমনও নয়। সবাই যেখানে স্বপ্ন দেখে সেখানে কার না মন চায়।
মোটামুটি কড়া গলায় আখের আয়মালাকে উদ্দেশ্য বলে উঠলো
-বারংবার না করার পরও এর মাঝে কি যে পাইছস জানি না। আমার শেষ সম্বল নষ্ট হইলে তখন বুঝবি।
আখেরের শাশুড়ি বলে উঠলেন- বাবা, সাহস কর। লস হলে আমি ক্ষতিপূরণ দিবো। তবুও সাহস কর।
সাধারণত মানুষ চোখ মেলে যতটুকু দেখে ঠিক অতটুকুই দেখে; তবে তা মাঝে মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেও হয় না। আর যা অনুমান করে তা কতটা পরিষ্কার তা তো সহজেই অনুমেয়। সামনে এগুতে গেলে হোঁচট খেতে হয় জেনেও তো আগানো বাদ দেয়া যায় না। মানুষের দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত শুধুই এগিয়ে যেতে হয়। স্থির থাকার কোন উপায় নেই।
পৃষ্ঠা-১৩
জীবনকে চেনে এমন কয় জন মানুষ আছে। বেশির ভাগ মানুষ যেমন আছে(বর্তমান) ঠিক অতটুকুই পেয়ে বেঁচে(শান্তি) থাকে। সকালে সূর্য উঠবেই; এটা প্রত্যেকটি মানুষের প্রত্যয়। তাই-ই ওঠে। অর্থাৎ দিন শুরু হয় মাথা উঁচু করে। কে আছে মাথা নিচু করে থাকতে চায়। মন বড় বিদ্রোহী সিপাহী, জয় তার ধ্যানে-জ্ঞানে।
আখের যা আয় করে তা তার আনন্দ; আর যখন লস করে তখন তার বেদনা/দুশ্চিন্তা। উদ্বৃত্ত সঞ্চয় হয়; কিন্তু ক্ষয় হলে তা হৃদয়েতে জ্বালা ধরায়। যা সত্য কর্মের, সত্য ঘামের সঞ্চয় তা নিয়ে জুয়া খেলা চলে না। প্রতিদিন একটা অজানা ভয় আখেরকে ঘিরে রাখে।
-এত অস্থিরতা নিয়ে ব্যবসায় নেমেছো কেন? টোপ না দিলে কি বর্শিতে মাছ আসবে?
-তবুও একটা হিসেব আছে।
-আজকে প্রতি পাল্লা বেগুনের দাম চলতেছে বিশ টাকা। গত পরশু দিন ছিল সতেরো টাকা। ভাবতে পারো এক ট্রাক মালে কত টাকা লাভ হচ্ছে।
-সে তো হিসেবের খাতায়। কিন্তু টাকা কই?
-হবে, সব হবে। ঢাকা থেকে মহাজন পাঠাইলেই ভাগ-বাটুয়ারার হিসাব মিলে যাবে। শুনতেছি দাম বলে আরও বাড়বে। দেশে যে ভাবে বন্যা আসতেছে। তাতে তরকারির দাম আরও বেড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। কিছু টাকা ক্ষেত মালিকদেরকে অগ্রিম দিতে হবে। এতে করে তাদের কাছ থেকে বাজার দামের চেয়েও কম মূল্যে কিনতে পারবো। লাভ টা আরও বেশি আসবে। তাই আরও কিছু টাকা লাগবে।
-ওই টাকাটা ঢাকা থেকে আনো। ওটা এনে কাজে লাগাও।
-মাথায় বুদ্ধি রাখো। পার্টির সাথে জবরদস্তি চলে না। শেষে হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
আখের তিন কিস্তিতে প্রায় পয়তাল্লিশ হাজার টাকা দিয়েছে। শুধু একবার- প্রথম প্রথম পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছে। এরপর বাকি সব যোগান ও লভ্যাংশ দু’টোই মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সেদিন রাতে আখের ঘুমাতে পারছিলো না। দু’চোখ বন্ধ করলেই নানান দুশ্চিন্তা মাথায় এসে শরীর ঘেমে তুলছে। আয়মালা বুঝতে পেলো আখের কোনো এক অস্বস্তিতে ভোগছে। কাছে গিয়ে বললো
পৃষ্ঠা-১৪
-এ তোমার অন্যায় হচ্ছে। তোমার দুশ্চিন্তার ভাগ কিছু আমাকেও দাও।
-ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। ও শুধরায় নি। রহিম বিলির মতিগতি আমার ভালো লাগছে না। ছোটবেলার মতোই তার কথা-কাজে কোনো মিল নাই। মিষ্টি মনে করে খেলেও স্বাদ লাগে তেঁতু।
-কিহ? (আয়মালার বিষ্ময়ে হয়ে জিজ্ঞেস করলো।)
-যা সত্য তাই বলতেছি।
আয়মালা চমকে উঠলো। আখেরকে বলা নানান কড়া কথা গুলো, মেনে নেয়া নানান শর্তগুলো, রহিম বিলির বিশ্বাসি মুখটা অবিশ্বাসী হয়ে উঠা আর্তনাদগুলো দমকা ঝড়ো হাওয়ার মতো বের হয়ে এলো বটে, কিন্তু তাতে কোনো অর্থবহ শব্দ সৃষ্টি হলো না।
-ব্যবসায় এটাই ঝুঁকি। আর ঝুঁকি থেকেই লাভ আসে।
-মূলধনই খোয়া গেলে? (বিরক্তির অস্ফুট আওয়াজ) আর লাভ!
আয়মালা আর কোনো কথা বাড়ালো না। ওর মাথায় বারবার কাজ করছে, সে নিজের জোরে স্বামীকে এ পথে নামিয়েছে। তাছাড়া রহিম বিলির মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্ণ বিশ্বাস যা তাকে ভরসা দিয়েছে। ব্যবসায় সফল না হলে সবকিছু চূর্ণ হয়ে যাবে। হয়ত ব্যবসায় সম্পর্কে আখের এত কিছু বুঝে না, তাই সে অন্য আশঙ্কা করছে। হয়ত এমন কিছুই নয়।
পরের দিন তার স্বামীকে বুঝিয়ে আবার বাজারে পাঠাল। এদিকে ক্ষেতের কাজ, আর অন্যদিকে সংসারের কাজ সব মিলিয়ে আয়মালার জীবনের উপর দিয়ে উঠে গেলেও তা সামলে দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছে।
দিন যায়, সময় যায়। আখের ও রহিম বিলির মাঝে কথা বাড়ে। রহিম বিলির দিক থেকে যে তার শত্রু তারা আখেরকে তার মূলধনের হিসেব কষে দেখতে বলে। যে তথ্য তারা দিয়েছেন তা আখের যদি বিশ্বাস করে তাহলে তার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। আর যদি বিশ্বাস না করে তবে তাকে প্রতি দিন কারোর মতো আশায় আশায় অপেক্ষা করতে হবে।
পৃষ্ঠা-১৫
মন এক বড় পবিত্র ভূমি। এখানে ভালো-মন্দ দু’টো নিয়েই খেলা চলে। আখেরের মন ভালো নেই। আয়মালা তা বুঝতে পেলেও কোনো প্রশ্ন করলো না। স্বামীর এমন গোমড়া মুখ দেখে আয়মালা মনে মনে উতল হয়ে উঠলো।
পরের দিন স্বামীকে বাজারের উদ্দেশ্যে বিদায় করে, ঘরের কাজকর্ম শেষ করে বাপের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। অল্পকিছু পথ সে যাওরার পর পথ পরিবর্তন করে রহিম বিলির বাড়ির দিকে রওনা দিলো। বেলা হয়ে গেলে হয়ত দেখা হবে না তাই সে কিছুটা জোর গতিতে রওনা দিলো। অবশেষে পৌঁছালো এবং রহিম বিলিকে বাড়িতেই পেলো।
রহিম বিলির সেই চেনা ব্যবহার। অত্যন্ত সাবলীল ভাবে আয়মালাকে গ্রহণ করলো। বসতে দিলো। খাবার দিলো। এরই ফাঁকে আয়মালা কথা তুললো বর্তমান ব্যবসার অগ্রগতি সম্পর্কে। ব্যবসায় লোকসান যাবে এমন কোন কারণ তার চোখে ধরা পড়লো না। কিন্তু প্রশ্ন জাগলো তার, সব মূলধন, সব লভ্যাংশ তো অন্যের কাছে পড়ে আছে। তাদের হাতে চলতি অর্থ নেই বললেই চলে। যে দুই-একজন টাকা পরিশোধ করবে তারাও সময় মতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে রহিম বিলি বলে উঠে-
এতো উতলতা মন নিয়ে ব্যবসায় নেমেছো কেন?
-ভাইজান, সবই বুঝি। কিন্তু সব টাকা হাত থেকে খুইয়ে এখন অন্যের হাতে রেখে বসে বসে লাভ হিসেব করা, এ কেমন ব্যবসায় গো? দেয়া-নেয়া না থাকলে তাকে ব্যবসায় বলে?
রহিম বিলির আর কোন কথা থাকলো না। ‘সে ভীষণ মনঃক্ষুন্ন হলো’ এর স্পষ্ট রেখা রহিম বিলির চোখে-মুখে ফুটে উঠলো। আরও কিছু কথা হলো। শেষে আয়মালা বিদায় নিয়ে চলে এলো।
বর্ষা এসে গিয়েছে। মাঝে মাঝে নীল আকাশ উঁকি দিলেই কি! সমস্ত প্রাণীকূলের প্রাণে মেঘের কালো অবয়ব জেগে উঠেই। আয়মালা এমন কিছুই ঠাহর পেলো।
সন্তানেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আখের বেশ রাত করে বাড়ি ফিরলো। আয়মালা তখনো কিছুই খায় নি। আয়মালার মুখে একটা বেদনার ছায়া। আখেরের মুখেও তাই। কোনো কথা না বলে খেতে বসলো। সাথে আয়মালা বসে পড়লো। আয়মালা কিছুই খেতে পারলো না। কেঁদে ফেললো।
পৃষ্ঠা-১৬
-বলেছিলাম, তোকে বলেছিলাম। কি দেখলি, বড় লোক হতে হবে। এখন হ!
-আমি রহিম বিলি ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। তার কথা বার্তা আমারও ভালো লাগেনি। মনে হচ্ছে আমাদের অংশীদার করেছে ঠিকই কিন্তু আমাদের দেয়া টাকা সে অন্য কাজে ব্যবহার করেছে।
-ধার দেনা দিয়েছে। পুরাটাই ঋণ পরিশোধে কাজে লাগাইছে। আমি এখন নিঃস্ব।
আয়মালার কান্না যেন থামছেই না। ক্ষেত্রবিশেষে, আপন জনের বোকামির কান্না তিক্ত লাগে। আখের আরও বেশি ক্ষেপে উঠলো।
-আমি কিছু জানি না, আমার ঘাম ঝড়া টাকা চাই। হয় রহিম বিলি না হয় তোর বাপ দিবে। আমি এক কথার মানুষ।
আয়মালার মাথার উপর যেন আসমান ভেঙ্গে পড়লো। বিশ্বাস ভঙ্গ, চেনা মানুষের অচেনা ব্যবহার, বাবা-মায়ের দারিদ্রতা। এসব যেন গর্জন তুলে আয়মালার মাথার উপর আছড়ে পড়তে লাগল।
পরের দিন আর আখেরের সাথে কথা হলো না। আয়মালা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। এরপর আরও দুই দিন বাড়ি ফিরলো না। শেষে খবর এলো, আজ বিকেলে বৈঠক বসবে। বাজার কমিটি ভার নিয়েছে রহিম বিলি ও আখেরের মাঝে গড়ে ওঠা ব্যবসার ভাগবাটুয়ারা নিয়ে। আয়মালা এখন কি করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। এমন সময় আয়মালার মা এসে হাজির। তিক্ত কিছু ভাবের বিনিময় হলো। আয়মালা জানতে পেলো যে, উক্ত বৈঠকে আখের তার শ্বশুরকে সাথে নিয়ে গিয়েছে। এতে করে তার দুশ্চিন্তা, হতাশা, মীমাংসা ইত্যাদি বিষয় মাথায় চেপে বসল।
শিশু ও মায়ের প্রতি খেয়াল, আবার দুশ্চিন্তা সব মিলিয়ে ঘরটা যেন এক নাট্যমঞ্চ হয়ে উঠলো।
-হ্যাঁ! আমি টাকা নিয়েছি, তবে যা বলতেছে তত টাকা নয়। (রহিম বিলি অস্বীকারের ঝাঁঝে বলল।)
-আমার কাছে সব লেখা আছে। (আখের স্পষ্ট করে বলল।)
-দেখা দেখি।
উপস্থিত মাতুব্বরগণ তা দেখতে চাইলেন। আখের অতি নির্ভিকের সহিত তা উপস্থাপন করল।
-মনগড়া লিখে রাখলেই হবে নাকি। আমার কাছেও লেখা আছে।
এই বলে রহিম বিলি তার টালি খাতা উপস্থাপন করলেন। রহিম বিলির কাছে থাকা খাতায় টাকার অংকের পাশে আখেরের স্বাক্ষর রয়েছে।
মাতুব্বরগণ শেষে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, আর তা হলো- রহিম বিলির খাতাতে আখেরের হাতে যে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা লেখা রয়েছে তা পরিশোধ করতে হবে। সেই সাথে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। অর্থাৎ চল্লিশ হাজার টাকা। নগদ বিশ হাজার টাকা(এখানে); আর বাকি বিশ হাজার টাকা তিন মাস পরে চৈত্রের শুরুতে দিকে।
অন্যদিকে বিভিন্ন পালাপর্বণে পঞ্চান্ন হাজার টাকা দিয়েছে যা আখেরের খাতায় লেখা আছে কিন্তু রহিম বিলির হাতের কোন স্বাক্ষর নাই। ফলে বাকি পনেরো হাজার টাকার কোন বাস্তব মূল্য পেলো না।
পৃষ্ঠা-১৭
তবুও মেনে নিলো আখের। যা অপচয় তা তো আর লাভের হিসেবে ফিরে আসবে না।
হয়ত একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে এমন আশায় ছিল আয়মালা। কিন্তু তাদের মাঝে (স্বামী স্ত্রীর) যে মনোমালিন্য ঘটে গেল, তা সময় পার হলোও আর জোড়া(সমাধান) লাগবে কি? সংসার জীবনে নানান ঘটনা ঘটেই থাকে; তবে যে গুলো তেমন কিছুই না; অথচ সে বিষয় ধরে নিয়ে বসে থাকলে সংসারে অনেক বেকায়দা পড়তে হয়। প্রাণ খুলে যদি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কথা না হয় তবে তা সময় পার হলে আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। মনে রাখা ভালো, নিরব প্রাণী ভয়ঙ্কর বেশি।
এরই মাঝে একদিন ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে আখেরের পা কেঁটে যায়। কোদালে কেটেছে তাই অনেক এবরোথেবরো ভাবে কেঁটেছে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ঠিক বিপদগুলো হল এমন যে, মালার পুতির মতো, একবার বিপদ শুরু হলে একের পর এক বিপদ আসতেই থাকে। কয়েক দিনের মধ্যেই দুই মেয়ের জ্বর হলো। একটি গরু মাঠে ঘাস খাওয়া অবস্থায় লাফ দিয়ে পড়ে মারা গেল। মোট কথা, দিনগুলোতে শুধু ঝাঁকুনি নয়; একেবারে গাছের গোড়া(মূল) পর্যন্ত নাড়া দিয়ে বসলো।
গচ্ছিত অর্থ দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। বিশ হাজার টাকা এনেই আঠারো হাজার টাকা দিয়ে একটা গরু কিনে ফেলে। বাকি দুই হাজার টাকা এই কয়দিনে দিনেই বিভিন্ন বিষয়ে শেষ হয়ে যায়।
একদিকে স্বামীর চাপাচাপি, আরেক দিকে সংসারের বেহাল দশা। সব মিলেয়ে বিশ্বাসের উপর ভর করে আয়মালা রহিম বিলির বাড়িত যায় কিছু টাকা চাওয়ার জন্য; যেন তারা এ আপদকালীন সময়টুকু পার করতে পারে।
আয়মালা অনেকটা সকাল সকাল গিয়েই রহিম বিলির বাড়িতে পৌঁছোয়। সেখানে গিয়ে দেখা আরেক কাণ্ড! তার মতো আরও কয়েক জন উপস্থিত। অথচ রহিম বিলির ঘরে তালা দেওয়া। সে রাতের আঁধারে বাড়ি ছেড়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে পালিয়েছে। পাশের বাড়ির একজন মুরুব্বি বললেন, হয়ত শহরে চলে গেছে। আর চলে যাবোই তো, শুধু শুধু জোড়া তালি দিয় কি আর ব্যবসা করা যায়! লাভের মুখ দেখবো কেমন করে?
পৃষ্ঠা-১৮
পথের ধুলোও এক সময় যন্ত্রণাময় কঙ্কর হয়ে উঠে তা মনে হয় আয়মালার জানা ছিল না। সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে তার পা ধরে আসছিল। এখন পর্যন্ত যতটুকুই হয়েছে তাতে স্বামী তাকে যতটা দূরে ঠেলে দিয়েছে, তা আর আগের মতো করে কখনো আর কাছে ডেকে নিবে না। তার উপর আজ রহিম বিলির নিরুদ্দেশ। তার ঘরটা যেন আজ ঘুর্ণিঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল।
ছেলেরা যা ছেড়ে দেয় তা হয়ত একেবারে ছেড়ে দেয় কিন্তু মেয়েরা আবার পূণবিবেচনা করে। আর ছেলেদের ক্ষোভও বেশি। আজকের যে দশা তার জন্য আয়মালা যে একাই দায়ী তা নয় বরং ঢের বেশি আখের। সে কেন পুরুষ মানুষের মতো সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলো না। আখেরের স্বভাব দেখে মনে হচ্ছে সে ঘর ছিড়ে ফেলতেই উন্মাদ হয়ে উঠেছে। বিবেচনা তার বিবেক থেকে মুছে গিয়েছে যেন।
মেয়ের এহেন দশা দেখে আয়মালার বাবা-মা তাদের বাড়ির কিছু জমি বন্ধক রেখে জামায়ের জন্য বিশ হাজার টাকা নিয়ে আসেন। টাকা পেয়ে আখের স্বস্তি পেলো নাকি লজ্জা পেলো তা তেমন বুঝা গেল না। কিন্তু সে টাকা টা নিয়ে পরের দিনের বাজার থেকে গরু কিনে নিয়ে আসে।
আয়মালা ভাবলো, যা হবার তা হয়েছে। এবার স্বামীর ভালো ব্যবহার আশা করে সে। আয়মালা মনে মনে পণ করে, যত ভালো ভাবেই স্বামীর সাথে মিশুক না কেন মনের যে ক্ষত তা সে জিয়াইয়া রাখবে। কিন্তু স্বামী(আখের) আর সেই দিনগুলোর মতো হলো না। আখের সবসময়ই কোথায় যেন একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। স্বামীর অশোভনীয় আচরণগুলোর প্রতি জন্মা ক্ষোভগুলো আয়মালার প্রাণে খিড়কি দেয়া ঘরের মাঝে বন্দি হয়ে রইলো। যে অনুভুতিটা তার গোসসা ছিল তাই যেন আজ কাঁটা হয়ে জীবিত রইলো।
বৈশাখের শেষের দিকে খোঁজ পাওয়া গেল রহিম বিলি তার স্ব-পরিবারে কান্ধির চর নামক এক গ্রামে স্ত্রী’র পক্ষের এক নিঃসন্তান আত্মীর বাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
ওই এলাকা আখেরের আবার বেশ চেনা। তাই পাড়ার কয়জন ছেলে পেলে সহ একদিন ভোর বেলা ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। রহিম বিলি কোথায় যেন যাবে। বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে, এমন সময় তাকে ঘিরে ধরে ওরা।
তাদের মাঝে নানান গরম কথা বার্তা হলো। রহিম বিলি ক্ষমা চেয়ে নিলো এবং আরও কিছু সময় চাইলো। কিন্তু আখের তা দিতে রাজি নয়। রহিম বিলি এখন একেবারে নিঃস্ব। দিন আনে দিন খায়। এখানে যে রয়েছে তা তার আত্মীয়ের দয়াতে।
আখের তার টাকা ফেরৎ পাবার কোন উপায় আন্ত না দেখে দেঊড়ির সাথে বেঁধে রাখা পোষা ছাগল টির খঁটি থেকে দড়ি খুলে নিয়ে সাথে করে রওনা দিলো।
পৃষ্ঠা-১৯
পেছন থেকে রহিম বিলির বউ আর ছোট মেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আখেরকে অনুরোধ করলো রেখে যাবার জন্য। তার আর্থিক ক্ষতিতে তারাও লজ্জিত। তারা কান্না ভেজা অনুরোধ করে কিছু সময় দেবার জন্য।
আখেরের মাঝে যেমন একটা সজীব মন ছিল, সরল মন ছিল তা আজ অর্থে চিন্তায় মাটি পড়েছে। রহিম বিলির পক্ষের কথাগুলো আখেরের হৃদয়ে আর কোন করুণার জাগায় হলো না।
শেষে সেই পোষা ছাগল নিয়েই চলে এলো।
পথের মাঝে একজন সঙ্গী জিজ্ঞেস করেছিলো- বোবা জানোয়ার! এভাবে তোমার আনা ঠিক হলো না। এদেরও একটা অভিশাপ রয়েছে।
-মাথার ঘাম পায়ে পড়া টাকা তোমার তো খোয়া যায়নি। আমার গিয়েছে। তাই পুরানিটা আমারই। কার কি হলো, তা এখন আর দেখার সুযোগ নাই।
আয়মালার বুঝার বাকি রইলো না যে, তার স্বামী পাষাণ হয়ে উঠেছে।
নিয়তির খেলা এটাই, ঘরে বসা টাকায়(সম্পদ) তো আর মানুষ চেনার যথার্থ উপসর্গ হতে পারে না। বিধাতা বরং হৃদয়ের লুকায়িত রঙটাই প্রকাশ করার জন্যই হয়ত এ ভেলকির খেলা দেখালো যেন।
আয়মালা আখেরের সাথে কোন কথা বললো না। আখেরের হাত থেকে ছাগলটির দড়ি সরিয়ে গোয়াল ঘরের পাশে বেঁধে রেখে পানি খাওয়াল। ছাগল পেয়ে এবং হাতে ধরতে পেরে তাদের আখেরের দুই সন্তান বেশ আনন্দ পেলো। অন্যদিকে পোষমানা ছাগলটি এদিক-ওদিক তাকায় আর শব্দ করে ডাকতে থাকে। আয়মালা খেয়াল করল – ছাগলটির চোখের কোণ ভিজে উঠেছে।
-তুমি মাটির দিকে তাকাও। চেষ্টা করলে বা উঁনি(বিধাতা) চাইলে আমাদের আবার সব হবে। কিন্তু পাপ হলে তা আর মাটি হবে না!
-তোর পাপ তখন কই ছিল যখন আমার কষ্টের টাকা মাটি করলো।
-হয়ত নিয়তিতে ছিল। না হলে আমাদের কেনই বা লোভ জগলো। এ ছাগলটা ফিরিয়ে দাও। তোমার টাকা তো পেয়েছো।
-না! পাই নাই। আরও বিশ হাজার টাকা বাকি। তোর অতসব বুঝার প্রয়োজন নাই। তুই-ই তো এ সব করলি।
-খ্যামতা নাই এইটা বলো। কারো দোষ দিওনা আবার।
এরপর দুই জনের মাঝে যা ঘটে গেল তা এই সভ্য জগতের সাথে একেবারে বে-মানান।
এই শীতল মাটির তলে যদি কিছু লোকায়িত থাকে তবে তা বের করে এনে প্রকাশিত করার মাঝেই যেন বিধাতার দেয়া ভেলকি। ইহলোকের পরীক্ষা নেবার উপসর্গ। এখানে যেন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেল!
অসময়ের বৃষ্টি শীতল বেশি। সেই পোষা ছাগলটি ঘরে তুলার কথা মনে না থাকার জন্য বৃষ্টিতে ভিজতে ছিল। অন্যদিকে অযত্ন তো আছেই। কয়েকদির থেকে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। মুখ দিয়ে লালা বেরুচ্ছে। নাক, মুখ দিয়ে পানি পড়তেছে। গা ফুলা ফুলা লাগছে।
মোট কথা রহিম বিলির ঘরে যে রকম আদরে ছিল, তা আর এখানে নেই। পোষ মানা ছাগলটি আর ভালো নেই।
সন্ধ্যা বেলায় ঘরে উঠানোর পর গায়ে জড়ানোর জন্য পাটের ছালা কেটে বিশেষ কায়দায় বানানো জামা পড়িয়ে দেওয়া হতো। আর এখানে এমন কিছুই নেই। মাশা-মাছির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ধোঁয়া দেয়া হতো, আরও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হতো। কিন্তু এখানে গোয়াল ঘরে গরুর সাথে থাকতে হয়। তাছাড়া শোবার স্থানটাও খানিকটা স্যাঁত-স্যাঁতে।
পৃষ্ঠা-২০
ছাগলটির এহেন অসুস্থতা দেখে আয়মালার খারাপ লাগে, কিন্তু তার কিছুই করার নেই। স্বামীর সাথে তার বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, সে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তার কি করা উচিত তা বুঝে না। তাছাড়া নানান সীমাবদ্ধতা তো আছেই।
এরও দিন-পাঁচেক পরে আবার বৃষ্টি শুরু হলো। সারাদিন বৃষ্টি। থামার কোন নাম নেই। এমন মৌসুমে বৃষ্টি খুব একটা হয় না। গরু না হয় খড় খায় কিন্তু ছাগল তো আর খড় খায় না। ছাগলটি একেবারেই খড়ে মুখ দেয় না। দিন রাত শুধু কলরব করে মরে। এমন অবস্থায় বাড়ির সবাই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এভাবে একটানা কলরব আর কতক্ষণ মেনে নেয়া যায়! আখের এক পর্যায়ে ছাগলটিকে মারতে তেড়ে গেল। কিন্তু বিবেক তো আর একেবারে মরে যায় নাই। গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখে পোষা ছাগলটি না খেয়ে খেয়ে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে। দাঁড়িয়ে আছে কেবল তার বিশেষ শক্তির বলে।
-ছাগল টা না খেয়ে মরতে বসেছে। কয়টা পাতা এনেও তো দিতে পারো।(আয়মালার উদ্দেশ্যে)
-কই পামু। হাবুলিদের কাঁঠাল গাছ থেকে পাতা পাড়তে গেছিলাম। নানান কথা শুনিয়েছে। আমাগো তো আবার কোন গাছ নাই যে পাতা আইন্যা দিমু।
আখের কোনো কথা বললো না বটে, কিন্তু মনে মনে ত্যাজ উঠলো। পরের দিন প্রায় দুপুর বেলা বৃষ্টি থেমে এলো। একে ঠিক থেমে যাওয়া বলে না; বিরতি বললে ভালো বলা হবে। আখের বাড়িতেই ছিল। সে ছাগলটা গোয়াল ঘর থেকে বের করে রাস্তার উপর খুঁটি গেড়ে দিলো। ছাগলটির কলরব থেমে এলো। ভেজা ঘাসের উপর মুখ ঘষে ঘষে খেতে চেষ্টা করলো। কিছুটা পারলোও বটে। তাতে পেট ভরলো না। আয়মালা কোথা থেকে যেন কিছু লতানু গাছ এনে সামনে দিলো। প্রায় পাগল পারা হয়ে খেতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখে আয়মালা খুুশি হলো বটে, মনে মনে ক্ষোভও জন্মালো। ছাগল বড় উপদ্রব। তাই সে গরু পালন করলেও কখনো ছাগল লালন-পালন করেনি। তাছাড়া এই ছাগল তার নয়। আখের প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিতে পারে। ঘটনাগুলো যে পর্যন্ত গড়িয়েছে তা আর আয়মালার হাতে নেই। তাই তার কোনো মন্তব্যও নেই।
আয়মালা ঘরে ফিরে গিয়ে দেখে আখের মাঁচা থেকে ধান বের করে মেঝেতে রেখেছে।
-কি করবেন?
-বেঁচবো।
-কি করবেন?
আখের কোন উত্তর দেয় না। যে মেয়েটা অসুস্থ সে মেয়েটা বিছানা থেকে করে দিয়ে কেঁদে উঠল। সব মিলিয়ে আয়মালার এতো রাগ হলো যে, সে আর কোন কথাই বলতে পারল না। মুখটা তার কালচে হয়ে উঠল।
পৃষ্ঠা-২১
আখের চকির ওপর মাথা নত করে বসে রইলো। আয়মালা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে স্বামীর পাশে বসলো
-আখের, খেয়াল করো, সময় একই রকম হয় না। ঠান্ডা গরম নিয়েই দিন শেষ হয়। কিন্তু মানুষকে পরিস্থিতি দেখে চলতে হয়। ঘরের কর্তাকে স্রোতে গা ভাসালে চলে না। তা উচিৎ-ও নয়।
এরই মাঝে আবার বৃষ্টি এসে গেছে। আখের নিঃশ্চুপ।
-আখের, জীবনের পথ অনেক লম্বা। আজকের দিনকে বড় করে দেখছো, আর সামনের দিন কে খাটো! ভেবে দেখো, আজকের দিনটাও পার করতে হবে, কালকের দিনটাও। সবদিন এক রকম না হলেও এগিয়ে যেতে হয়।
বাইরের বৃষ্টি আরও ঘন হয়ে এসছে। সেই সাথে বাতাস যুক্ত হয়েছে। তখনও আখেরের মাথা নত করেই বসে রয়েছে।
-তুমি, আমি দুই জনে আবার এক সাথে কাজ করবো। প্রয়োজনে আগের চেয়েও বেশি কাজ করবো। আল্লাহ সুস্থ রাখলে আবার আমাদের সুদিন ফিরিয়ে দিবেন।
এমন সময় ছাগলের কথা মনে করে আয়মালার ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। ভাঙ্গা একটা ছাতা নিয়ে দৌড়ে বের হবে এমন সময় আব্বাস ব্যাপারী ভিজতে ভিজতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। আয়মালার বুঝার বাকি রইলো না যে, আখের কেন মাঁচা থেকে ধান বের করেছে। আয়মালার মনের ভেতরটাতে যেন কেউ কাঁচ দিয়ে এঁকে দিলো- এমন কষ্ট অনুভূত হলো তার, এর আগে সে কখনো এতো কষ্ট পায় নি। তার দু’চোখ জলে ছলছল করে উঠলো।
আয়মালা, দৌড়ে গিয়ে ছাগলের খুঁটি তুলে নিয়ে ছাগল সহ ঘরে ফিরলো। ছাগলকে গোয়াল ঘরে বাঁধার সময় শোবার ঘর থেকে আব্বাস ব্যাপারি সহ তার সন্তানের চিৎকার ভেসে এলো। আয়মালা চিলের মতো উড়ে ঘরে গিয়ে দেখতে পেল আখেরের মুখে ও তার হাত-পা বাম পাশ বেঁকে গিয়েছে। মুখ থেকে লালা বেরুচ্ছে।
এর পাঁচদিন পর রাতের বেলায় সেই পোষা ছাগলটির মরদেহ গোয়াল ঘরের ভেতর থেকে পাওয়া গেল। মূলত ঠান্ডা ও অন্যান্য অসুস্থতা এবং অযত্নে মারা গিয়েছে।
রহিম বিলির মেয়ে তার পোষা ছাগলটির চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অনেকটা কাকতালিও ভাবেই ওই দিন সকালবেলাতে রহিম বিলি, রহিম বিলির স্ত্রী ও অসুস্থ মেয়েকে একটা ভেনে করে আখেরের বাড়িতে পৌঁছাল। কোনো উপায়ান্তর না দেখে ভ্যানে শুয়ে শুয়েই এসেছে পরাণ সমতুল্য পোষা ছাগলটিকে মুক্ত করে নিতে।
পৃষ্ঠা-২২
মারা যাওয়া ছাগলটাকে ঘিরে উৎসুক পড়শিদের জটলা পড়েছে। রহিম বিলি, তার স্ত্রী ও মেয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটির চোখ পড়ল নিথর পড়ে থাকা তার পোষা ছাগলের চোখের পরে। মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। এক অস্ফুট আওয়াজে বাবাকে সাক্ষী করে আর কাঁদে কেবল।
এ ঘটনায় কার মনে কি খোরাক হলো জানি না, তবে মেয়েটির হৃদয় পুড়ে গেল। হয়ত বা মেয়েটির মা; তার বাবা সমান্য কিছু বুঝতে পেলো। আয়মলা আর আখেরের চোখ দিয়েও জল বেরুলো।
সবাই সবার মতো কথা-বার্তা আর ধিক্কার দিতে ব্যস্ত। কিন্তু মেয়েটা নীরব রইলো। ছাগালের চোখে চোখ রেখে কি যেন বিনিময় করলো। ডাগর নয়নে তাকিয়ে থেকে শান্ত্বনা খুঁজলো হয়ত। শেষে বললো
-বাবা, কালো ভাইয়ের চোখ টা নিভিয়ে দাও।
রহিম বিলি, স্ত্রী ও মেয়েটি চলে যাবার সময় মেয়েটি তার বাবাকে আবার বললো
-আমরা যেই বারোশ টাকা এনেছি তা দিয়ে দিলেও আমার কালো ভাইকে নিতে দিবো না– বাবা?
মর্ত্যের ভেলকিতে মানুষের এটাই নিষ্ঠুরতা/বর্বরতা করে তুলে যে সে পশুর চেয়েও নিঃকৃষ্ট হয়ে যায়। আমরা ঠুঙ্কু লোভ/কর্ম থেকেই পশু হয়ে উঠি। আর এটাই স্বর্গের পরীক্ষা।
পৃষ্ঠা-২৩
গল্পেরে নামঃ পোষা ছাগল
লেখকঃ তারিকুজ্জামান তনয়
০৯ ডিসেম্বার’২০২০ ,ঢাকা।
“মানুষ মূলত নিজের অবস্থান ছেড়ে সব সময়ই ছুটে চলে যেতে চায়।”
📖 Bonopushpa থেকে কিছু ছোট রূপের রচনায় লিংকসহ তালিকা
-
স্ত্রী জান্নুর অনুযোগ — ছোট সামাজিক গল্প → bonopushpa.com/sri-jannur-onujug bonopushpa
-
বিনয় — গাছ ও ফুলের মাধ্যমে প্রতীকী গল্প → bonopushpa.com/binoy bonopushpa
-
বনলতা ও আমি — সম্পর্ক ও সময়ের নীরবতা নিয়ে গল্প → bonopushpa.com/banalata-o-ami bonopushpa
-
স্ত্রী জান্নুর অনুযোগ — ছোট সামাজিক গল্প → bonopushpa.com/sri-jannur-onujug bonopushpa
-
বিনয় — গাছ ও ফুলের মাধ্যমে প্রতীকী গল্প → bonopushpa.com/binoy bonopushpa
-
বনলতা ও আমি — সম্পর্ক ও সময়ের নীরবতা নিয়ে গল্প → bonopushpa.com/banalata-o-ami bonopushpa
📚 বনপুষ্পা থেকে রচনাগুলোর তালিকা
-
হয়ত কেউ-ই বলেনি — Link
-
নতুন অতিথি — Link
-
মেঘ হয়ে — Link
-
এতোটুকু কথা — Link
-
ফুল নেবে — Link
-
বনলতা ও আমি — Link
-
গোলাপ ফুলের কথা — Link
-
প্রিয় — Link
-
কাশফুল — Link
-
না বলা দুঃখ — Link
-
ফিরে তাকাও — Link
- মেঘদূত → bonopushpa.com/meghdud bonopushpa
🌿 বুনোপুষ্প – সাহিত্য সুখী করে
🍊🍏 ওয়েবসাইট: 👉 www.bonopushpa.com
🦂🦂🦜🦜🌹🌹🌹🥀🥀🍂🍂🍁🍁🍁🪸🐚🍄