গোলাপ ফুলের কথা – প্রকৃতি, প্রেম আর মানবতার প্রতিচ্ছবি | Tariquzzaman Tonoy
🌸 গোলাপ ফুলের কথা
✍️ লেখক: তারিকুজ্জামান তনয়
তখনকার সময় গ্রামের বাড়িগুলো আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ছিল। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও অন্ধকারের মাঝে জীবন যাপন করে থাকলেও তাদের মাঝে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবোধ বা জ্ঞান ছিল। কিন্তু এখনকার সময়ে এসে মানুষগুলো তার বাড়ির আঙিনায় থাকা প্রকাণ্ড গোছের গাছগুলোকে কেটে কাঠের উপর আলপনা এঁকে ঘরে আসবাবপত্র বানিয়ে সাজিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করে থাকেন। অথচ তখনকার সময় বাড়ির আঙ্গিনাতে বড় গাছগুলোকে রেখে দেওয়ার প্রতিই বেশি প্রীতি ছিল। বিশেষ করে ফলমূলের গাছ, ফুলের গাছ, বনজ কিংবা ঔষধি গাছ। যদিও এখন আর সেই সব গাছ নেই কিংবা সে গাছ কয়েক পুরুষ আগেই কেটে ফেলা হয়েছে, অথচ এখনও সে গাছের নাম অনুসারে ওই জায়গাগুলোর নাম এখনো রয়ে গিয়েছে। আমতলা, লিচুতলা, বেলতলা, বকুলতলা ইত্যাদি। এবং এসব ঘিরে ছোটবেলার কত যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাদের। এখনো মনে হলে তাদের চোখে জল চলে আসে।
মানুষ স্বাধীন বলে চিৎকার করে। কিন্তু আমি বলি কি, তারা কি মূর্খ নয়? এর চেয়েও সেই ব্যক্তিটি আহাম্মক, যে নিজের সময়টুকু নষ্ট করে অন্যের ওপর অযথা কর্তৃত্ব/অন্যায় করে থাকে। আজকের যে দিনটি/সময় পার হলো, তার থেকে সে কতটা সময় নিজেকে দিয়েছে? যদি অন্যকে চর্চা করে সময় পার করে থাকে, তাহলে বিধাতার দেওয়া নিজের সৌন্দর্যটাকে সে কখন দেখবে?
মানুষ কতটা পরাধীন তা প্রতিটি মর্মেই প্রমাণিত। ঠিক একটু আগেই যে সময়টুকু জীবন থেকে চলে গেল, তার আর কোনো দিনও ফিরে পাবে না। সেই ছেলেবেলা ঘিরে সেই দুরন্তপনা, ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দ, এ বয়সে এসে বেমানান লাগে কি? সত্যিকার অর্থেই সে আনন্দ তিক্ত হয়ে বেজে ওঠে।
শক্ত টিন দিয়ে ঘেরা ছিল গ্রামের বিদ্যালয়গুলো। বিদ্যালয়ের বাগানগুলো ছিল বাঁশের বেড়ায় ঘেরা। তাতে ছিল নানা রকম ফুলে যেমন– জবা, হাসনাহেনা, গেটফুল, সূর্যমুখী, পেঁয়াজফুল, পাতাবাহার, মোরগফুল, গাঁদা ইত্যাদি ফুল। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে- পুকুরপাড় দিয়ে ঘুরা; কৃষ্ণচূড়া ফুলের মণি দিয়ে যুদ্ধ করা, স্কুলমাঠে রোদের মাঝে দৌড়াদৌড়ি। ফুটবল, ভলিবল খেলা ইত্যাদি। আমরা কেন যেন বুঝি না যে, কী কী কাজ দ্বারা পৃথিবীটাকে বিবর্ণ করে তুলছি; ঠিক আমাদের পূর্বপুরুষগণও হয়তো বুঝেননি কী কী আশীর্বাদের মধ্যে তারা ছিলেন।
সপ্তম শ্রেণি শেষ করে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীর পড়ালেখার চাপ কিছুটা বেশি। তাছাড়া অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী ক্লাসের বিভাগ নির্ধারণ হয়ে থাকে। এতদসত্ত্বেও জসীম তার বাগান পরিচর্যার সৌন্দর্যবোধকে কখনোই এড়িয়ে চলে নি। সে নিয়মিত খেলাধুলা করত। রাতের বেলায় কুপি জ্বালিয়ে তার সাধ্যমতো রাত জেগে পড়াশোনা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ত। সে সময়টায় সন্ধ্যা এলে পুরো গ্রামজুড়ে অন্ধকারে ডুবে যেতো। শান্ত-শীতল-নীরব ছিল সে সময়কার গ্রামগুলো। ঝিঁঝি পোকার সাথে নাম না জানা কত শত পতঙ্গ, পশুপাখির আওয়াজ ভেসে আসত।
জসীমদের একটি পারিবারিক বাগান ছিল। চারচালা ঘরের বারান্দা ঘেঁষা। যেখানে একটা জানালা ছিল। সে জানালার কাছেই জসীমের পড়ার টেবিল। জানালার ওপাশে এক প্রকাণ্ড গোছের গন্ধরাজ ফুলগাছ ছিল, যা বাড়িতে প্রবেশদ্বার ও বারান্দার টিনের চালা পর্যন্ত ছেয়ে ছিল। এছাড়া লালগোলাপ, মোরগফুল, পেঁয়াজফুল, গাঁদা, পাতাবাহারসহ এমন আরও বেশ কয়েক রকমের ফুলের গাছ ছিল। সব মিলে ওদের এ বাগানটা বাড়ির সৌন্দর্যকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
বসন্ত ঋতু চলছে। রাত্রিকালীন শীতের আবহ তখনো বিদ্যমান। ঝড়ো বাতাসের সাথে বৃষ্টি যুক্ত হয়েছে। পরের দিন সকালবেলাতেই সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যালোর সাথে মিশে গাছপালা, লতা, ফুলগুলো একসাথে মিশে এক অন্যরকম সজীবতায় সেজে নববধূটির রূপসজ্জকে হারিয়ে দিয়েছে।
জসীমদের বাগানে একটি গোলাপ গাছের তিনটি কলি ছিল। এর মধ্যে একটি কলি এই কিছুটা সময় পূর্বেই ফুটেছে। টকটকে লাল পাপড়ি মেলা তরুণ সে গোলাপ। তার গায়ে রোদ পড়েছে সকালেই। এখন সে গন্ধরাজ গাছের ডালে ফুটে থাকা সাদা ফুল আর কাঁচা সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে আসা আলোর সাথে ক্রীড়ায় মেতেছে। একই সাথে মৃদু হাওয়া গোলাপের গায়ে পড়ে এক অন্যরকম সম্মোহন তৈরি করছে।
জসীমদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা রাস্তা থেকে বাগানটি সহজেই চোখে পড়বে। এ রাস্তার মাথায় দৈনিক সকালবাজার। বাতাসের দোলায় গোলাপ ফুলটি আরও নৈপুণ্য আরও সুন্দর মনোলোভা হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে, যা রাস্তা দিয়ে চলা যে কারোরই মন কেড়ে নিবে।
জমীর শেখ প্রবীণ ব্যক্তি। পড়ালেখা জানা মানুষ। তার ছেলের ঘরের নাতিকে নিয়ে সকালবাজারে যাচ্ছিলেন। বাগানের সে তরুণ গোলাপটি তার মন কাড়ল। জমীর শেখ গোলাপের সৌন্দর্য দেখে থেমে গেলেন।
অপূর্ব সুন্দর গোলাপটি আপন মহিমার তেজে মহিয়ান হয়ে উঠেছে। এর মাঝে বাতাস এসে দোলা দিয়ে গেলে সে আরও মায়াবী হয়ে উঠছে।
পৃষ্ঠা-০১
জমীর শেখকে তার নাতিকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘দাদু থেমে গেলেন কেন?’
উত্তর দিলেন- ফুল ভালোবাসো?
-জি দাদু! সে তো সবাই বাসে।
-সবাই বলে কিন্তু বাসে না।
-এ কেমন কথা? ফুলকে অপছন্দ করে এমন কেউ কি আছে?
-দাদু, তুমি একটু ভেবে দেখো, ফুলের একটা পবিত্র গঠন আছে।
-হ্যাঁ দাদু, আছে।
-অনেক ফুলের সুগন্ধ আছে, আবার কোনো ফুলের নেই। তবে প্রত্যেক ফুলের একটি সুশ্রী অবয়ব আছে যা সবার হৃদয়কে পুলকিত করে তুলে। হৃদয়ের পবিত্র স্থানে তুলে এনে তাকে স্থান দেয়।
-জি দাদু! তাই তো ফুল নিয়ে এত মাতামাতি।
জমীর শেখ মৃদু হেসে বললেন- কাউকে ফুল দেওয়ার অর্থ জানো? সে ব্যক্তি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি তার হৃদয়ে যতটা পবিত্রতা গড়ে তুলেছে কিংবা সৌন্দর্য বোধ গড়ে তুলেছে তা তো আর হৃদয় খুলে দেখানো যায় না। ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি স্বরূপ ফুলকে নিবেদন করা হয় কিংবা ফুলের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
-দাদু, প্রেম ঠিক অতটুকুই?
-অন্তরে জেগে ওঠা প্রেমের বাহ্যিক রূপ– ফুল। ফুল হল নিবেদন সেতু।
জমীর শেখ আরও বললেন- অকারণে ফুল ছিঁড়ে ফেলাকে হত্যার সঙ্গে তুলনা করা যায়। ফুল আপন সৌন্দর্য নিয়ে হাসিমুখে ফুটে থাকে। আবার আপন লীলা শেষ করে তার সার্থক সমাপ্তি ঘটে। তবে হ্যাঁ, গোলাপ ফুলটি তার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে কারো হাতে কিংবা গলার মালা হয়ে জড়িয়ে থাকতে। কারও ঘর কিংবা টেবিল সাজাতে। কারও সুখে সে পাপড়িগুলো ঝরনার ধারার মতো ঝরঝর করে ঝড়ে পড়ে মনোরঞ্জন করে।
একজন বাউল সাধক ওই পথ ধরেই যাচ্ছিলেন। পূর্বপরিচিত ছিলেন, তাই জমীর শেখকে দেখে সে থেমে গেলেন। পরস্পরের মধ্যে কুশল বিনিময় হলো। প্রসঙ্গক্রমে গোলাপ ফুলের কথা উঠে এল। বাউল সাধক বড় সরল মানুষ। প্রকৃতির রহস্যময়তার মাঝে গভীর দর্শন দেখতে পান। চোখের দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি সাথে বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে মেলবন্ধনের মাধ্যমে তিনি এক গভীর দর্শন খুঁজে পান। অবশেষে বাউল সাধক স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গেয়ে উঠলেন-
‘সুখের ঘরে আছে শত গঞ্জনা! গঞ্জনা!
সাধু সে মরলি ঘুরে,
ফুলের রূপ গুনে গুনে;
ভোরের আলোয় সজীব হল,
বাউল তুমি কেঁদে পেলি সান্ত্বনা। সান্ত্বনা।
কেউ আছে প্রেমেরে কাঙাল, কেউ আছে দুনিয়ার;
শেষে দেখি তারাই সুখী প্রেমের মূল্য যার!
সাধু নাকি অধম অধম – কে আছে পড়িয়া?
গোলাপ ফুল কয় হেসে
গোলাপ ফুল কয় হেসে- যখন যায় ঝড়িয়া! ঝড়িয়া!’
-যা রূপের আকার তা আবার বেদনার আকর হয়। (বাউল সাধকের কাঁধে হাত রেখে জমীর শেখ বললেন।)
সংগত কারণেই বাউল সাধকের চোখ ছলছল করে উঠলো।
বাউল সাধক আবার গেয়ে উঠল-
‘বিধি সাজালেন যে রূপ অপূর্ব সুন্দর করে,
মোরা সে রূপেই হই রূপসী;
আবার কোন্ খেয়ালে ভাঙলে সে রূপ?-
তবুও তা-ই ভালো;
তোমার-ই কীর্তন রচি।’
পৃষ্ঠা-০২
এমন সময় একজন পুঁথিকার যাচ্ছিলেন। সে খুব হাসিখুশি মানুষ। তার নাম জালাল।
-কোথায় চললেন? (জমীর শেখ)
পুঁথিকার জালাল:
যাই বাজারে, গিন্নীর ফরমায়েশে।
দিয়েছেন ফর্দ– নিতে হবে গুনেগুনে!
একটা যদি ছুটে, গোলযোগ বেঁধে যাবে;
কড়া শাসন!
বুঝলেন মশাই-
স্ত্রীলোক, কিচ্ছু বলা যায় না!
ফের যদি রাগ হয়
খাবরদারি বেড়ে যাবে দ্বিগুণ!
মশাই,
কী হয়েছে এমন, বাউল কেন কাঁদে,
চোট লেগেছে প্রাণে- কোনো কারণে?
জমীর শেখ-
হেতু বটে, কারণটা যথার্থ,
ঘোমটা ছেড়ে ফুটলো গোলাপ,
ঝরে গেলা বিকেলই!
জালাল-
আর কি বলি- সবাই জানি,
মায়া আছে জাদুকরী!
এত শুধু ফুল নয়- প্রিয়ার ছবি খানি
ভেসে ওঠে পাপড়ি মেলি।
কন তো ভাই, এর মাঝে কি আছে?-
মন জুড়িয়ে যায় যতবার চাহি।
একথায় ওকথায় প্রেম শুধু বাড়ে,
ঝড়ে যায় এক সময়- তা কি মানে?
শেষে হাসিমুখে নীরবে যায় ঝরিয়া,
দিয়ে গেল প্রেম টুকু, আপন জীবন বিলিয়া।
এখানে, আরও কয়েকজন এসে দাঁড়াল। মৃদুল-শীতল বাতাস বইছে গাছের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে। আলোচনার বিষয়গুলো যদিও সবারই চেনা এবং জানাশোনার মাঝে; অথচ কত ভারী, কত ভালো লাগা মিশে আছে।
পৃষ্ঠা-০৩
এমন সময় এপথ ধরে একজন স্কুল শিক্ষক যাচ্ছিলেন। তাঁর নাম আক্তারুজ্জামার সাইফুল। তিনি একজন কবি। তাঁর বেশ কিছু কবিতা জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সাইকেল থেকে নেমে এসে সালাম বিনিময় করলেন। স্যারকে দেখে উপস্থিত সবার মাঝে এক আনন্দ আমেজ বয়ে গেল। তিনি উপস্থিত সকলের খুচরো কথাগুলো থেকে বুঝে নিলেন, একটি গোলাপকে কেন্দ্র করে আলোচনা চলছে। গোলাপ নিয়ে একটি কবিতা শোনতে উপস্থিত সবাই আর্জি করে বসল। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নেই, বিশেষ কোনো গভীর উপলব্ধিও নেই। স্যার কিছুটা ঝিমিয়ে নিলেন। কি করে কবিতা বাধা যায় তা নিয়েই স্যারের চোখে-মুখে একটা ঘোলাটে ছায়া জমে উঠল। সবার চোখের দিকে দু-চার মিনিট চেয়ে নিলেন। এরই মধ্যে পুঁথিকার আবার তার কণ্ঠে পুঁথি তুলে নিলেন-
‘আরে আরে আরে আরে আরও ফুল আছে কত,
তন্মধ্যে গোলাপ ফুল কত সুন্দরও!
জগৎ জুড়ে আছে তার কত সু-খ্যাতি,
বাহারি রঙে তার শত প্রীতি!
আরে আরে আরে আরে আরে গোলাপেরও প্রেমে,
সন্ন্যাসী হলো প্রেমিক, প্রেমিক হলো সন্ন্যাসী!
ঘরকোণে মেয়েটির মন আনচান করে,
সমাজেরে লাথি মেরে ছুটে প্রেমের টানে!
আরে আরে আরে আরে আরে শোভা পেলো কত,
নানা বিধও অনুষ্ঠানে পালা পার্বণও!
সব খানে লাগে তার বাড়ে সৌন্দর্য,
অতিথি খুশি হন মন ভাসে আনন্দেরও!
আরে আরে আরে আরে আরে গোলাপ ফুল পবিত্র,
মানুষের মনকে পবিত্র হতে জাগায় আরও উৎসাহ!
সারা দিন-মান আনন্দ দিয়ে সাঁঝের বেলায় বিদায়ে-
হাসি মুখে চুপিসারে -ঝড়ে-পড়ে!
এতটুকু ক্লেশ নেই, নেই তার বদনে।
নীরবে ভুবন সাজালো, বিদায় নীরব প্রস্থানে!
আ…..রে…রে…রে….রে… কি শিক্ষা পেলে,
দ্যাখো, সকালে সে যৌবনা, আবার বিকেলে সে ঝরে পড়ে….!’
বাহ! এমন মুগ্ধ সুরে সবাই যখন মনমুগ্ধকর চিত্তে শোনছিলেন, ঠিক তখনই স্যার তার আবেগি সুরে কবিতা আবৃতি শুরু করে দিলেন-
দ্যাখো দু’চোখের খোলস খুলিয়া
বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি খুঁজিয়া;
শিশুর কোমল রূপে গোলাপ সাজে,
যৌবনের গান হয়, বৃদ্ধের পুণ্যে সাজিয়া।
পৃষ্ঠা-০৪
বায়ু এসে দেয় দোলা,
গোলাপ দোলে;
সূর্যালোক হাসি ছড়ায়,
গোলাপ হাসে।
মেঘ এসে দেয় আড়ি,
গোলাপ হয় গোমড়া;
বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয়,
গোলাপ হয় তন্মনা!
পথিকের ভুলায় মনন, প্রেমিককে যৌবনা;
শিশিরে দ্যুতি ছড়ায়, বাতাসে সুগন্ধির আলপনা!
জীবন খুঁজে জীবনের পথ, মাঝের পথটুকু কর্মদ্যোতনা;
প্রভাতে নব-নূতন, সাঁঝের বেলায় বাড়ে বেদনা।
লকলকে তরুর মতো উঠে গিয়ে বাউল সাধক দু’হাত উঁচিয়ে ছন্দ তুলে গেয়ে উঠল-
আমি আমারে দেখি নাই।
চোখ মেলিয়া স্বপন দেখেছি,
স্বপ্নে আবার রাজা হয়েছি;
রাজার স্বপন খাইলো জীবন-
শেষে অন্ধ হয়েছি!
আমি আমারে দেখি নাই।
জীবন-জীবন করে হলি পেরেশান,
মৃত্যু আছে পিছন পিছন- কীসের আস্ফালন?
চোখ মেলিয়া দেখ সবে, মাটির তলে ঘুমায় রবে,
ভালোবেসে তোমায় মনে রাখবে কয়জন?
আমি আমারে দেখি নাই।
ঘুরে ঘুরে দেখলি সবই,
চোখের পাতা খুলি-খুলি;
হৃদয় ঘরে আরেক জগৎ
তারে কোন আয়নায় দেখলি?
আমি আমারে দেখি নাই।
যে চোখ মানুষের অন্তর আত্মার অতৃপ্ত বেদনাগুলোর রং দেখতে পান, সেই ব্যক্তিটিই বিনয়ী হন। সে সবসময় ব্যথিত থাকেন। ভুলে ভরা মানুষগুলোর হৃদয়ে ভুল আর স্বার্থের কাল পাথরঘেরা মিথ্যে অহংকার ভরা কুৎসিৎ বর্ণ দেখে সে কেঁদে ওঠেন। আর আমরা একে বাউলের ভাষা বা গান বলে থাকি।
এখানে বয়স ও শিক্ষা-দীক্ষার উপর ভিত্তি করে উপস্থিত দশ-পনের জনের মধ্যে হাজারো দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হল। বাউল সাধক, পুঁথিকার, কবি কিংবা জমীর শেখের কথাগুলো থেকে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মনের খোরাক মিটিয়ে নিলেন। এদের মাঝে অনেকেই আছেন কিছু বিষয় কোনোভাবেই তাদের হৃদয়ের দুয়ারে পৌঁছাল না। আবার এমন অনেকেই আছেন তাদের হৃদয়ে উপরিউক্ত কথাগুলো উপলব্ধিপূর্বক শিশুটির মতো কেঁদে উঠেছেন। মানুষ মাত্রই তার আপন ঢংয়ে চলেন। আপন আচরণে নিজের পরিচয় তৈরি করে থাকেন।
পৃষ্ঠা-০৫
জমীর শেখ, উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শীতল কণ্ঠে বললেন- আমরা চাইলেই গোলাপ ফুলের মত সুন্দর জীবন গড়তে পারি। আমরা চাইলেই মুখের হাসিটাকে কোমল করতে পারি। আমরা চাইলেই জীবনকে কর্ম, পরোপকারে ও ভালোবাসার দ্বারা যৌবনা করে তুলতে পারি। আমরা চাইলেই শুভ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারি।
উপস্থিত একজন বয়োবৃদ্ধ লোক বলে উঠলেন- কম্মই স্বর্গ আর কম্মই নরক। আর জ্ঞান-বুদ্ধি এ দুইয়ের দুয়ার।
কবি প্রত্যুত্তরে বলে উঠলেন- জীবনকে পুড়িয়ে জীবনের শেষ কথাগুলো কত চমৎকার হয়! কত অর্থপূর্ণ হয়! কত তাৎপর্যপূর্ণ হয়! সূর্যালোক পৃথিবীকে আলোকিত করে, উজ্জ্বল করে। ঠিক তেমনি কিছু কথা, কিছু উপলব্ধি অন্তর আত্মাকে ঝলকায়ে তুলে মুখায়বে সৌন্দর্য ছড়ায়।
পরস্পরের কথাগুলো পরস্পরের মাঝে বিনিময়ের ফলে কিছু অগোছনো আওয়াজ তৈরি হলো। অন্যদিকে বাজারের বেলা বয়ে যায়। এদের মাঝে কয়েকজন ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছেন।
জমীর শেখ হঠাৎ করে দেখতে পেলেন, তার পাশেই দাঁড়ালো লোকজনের পেছনে গোলাপের পাঁপড়ি পড়ে আছে। আরও ভালো করে খেয়াল করে দেখেন যে, ষোল-সতেরো বছর বয়সী একটি ছেলে গোলাপ ফুলের একটি কাণ্ড হাতে নিয়ে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে; আর কাণ্ডটি হাতের আঙুলে ঘুরাচ্ছে। এবার জমীর শেখের চোখ পড়ল সেই বাগানটির দিকে। পরে বিষয়টা সবারই নজরে এলো। ছেলেটিও বুঝতে পেল সে কি ভুল করেছে। ছেলেটি লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে এল।
কবি আবার গেয়ে উঠলেন-
যা সুন্দর, তা তোমাকে দেওয়া উপহার;
আরও উপহার তোমাকেই- এ বিবেকের স্বাধীনতা!
গড়া-ভাঙ্গার মাঝে সত্য তুমি,
তুমি অজস্র উন্মাদনার মাঝেও হিসেবে বন্দী!
যা কিছু আজ নিয়ে নাও আপন হরষে,
ফের দাম হবে হিসেব কষে কষে!
না ফুল, না জীবন, না পৃথিবী,
সকল সাজ তোমাকেই করতে রূপসী!
—
পৃষ্ঠা-০৬
📅 লেখক পরিচিতি ও প্রকাশকাল
লেখক: তারিকুজ্জামান তনয়
স্থান ও সময়: মে ২০২৫, শেওড়া, ঢাকা।
কাউকে ফুল দেওয়ার অর্থ জানো? সে ব্যক্তি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি তার হৃদয়ে যতটা পবিত্রতা গড়ে তুলেছে কিংবা সৌন্দর্য বোধ গড়ে তুলেছে তা তো আর হৃদয় খুলে দেখানো যায় না। ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি স্বরূপ ফুলকে নিবেদন করা হয় কিংবা ফুলের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
ছোটগল্প : গোলাপের হাসি ফুটেছে , বনলতা ও আমি , দৌবযোগ
কবিতাগুলো-
আর্টগুলো-
বাংলা শায়েরী-
সনেট-
প্রবন্ধ-
📌📌📌🌳🌳🌳🦋🦋🦋📍