একরাতের অমলের স্বপ্ন

গন্ধরাজ ফুলের সুবাস আর ভোরের আলো এক সাথে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে একটা রমরমা ভাব তৈরী হলো। আজ মনটাও বেশ সতেজ। এক কাপ চা নিয়ে জানালার পাশে পেপার মেলে ধরে অমলকে তার মেজাজ সর্ম্পকে জিজ্ঞেস করা হলো। জিজ্ঞেস করতেই এমন একটা কথা বলে বসলো যা শোনে আমি কোনো উত্তর খুঁজে তো পেলামই না বরং তা শোনে ঘাবড়ে গেলাম। অমল আমাকে জিজ্ঞেস করল- জ্বীন বা ফেরেস্তা মানুষের বেশ নিতে পারে? অথবা মানুষকে, এই ধরো আমাকেই বা আমার ফ্যামিলির আশীর্বাদ দূত হয়ে মানুষ রূপে আসতে পারে?
আমি কথাটা শুনে না শোনার মতো করে আবার বললাম- অমল, চা খাবে? বানিয়ে দেবো? আর, এ বিষয়টা ভেবে কী হবে? দাদুর দাদুদের আমলে এমন হতো, শুনতাম। তখনকার সময় মানুষগুলো পুণ্যবান ছিলেন। তখন হয়ত সম্ভব হতো! তবে এখন কী আর পুণ্যবান সাধক আছেন?
আমি রান্না ঘরে গেলাম। দুই কাপ চা বানিয়ে এসে দেখলাম তখনও অমল খুবই বিমর্ষ এবং চিন্তিত। সেই সাথে গুটি কয়েকটা প্রশ্ন বিড় বিড় করে আওড়িয়ে চলছে- “আমরা নিজেদেরকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে পরষ্পরের সাথে সর্ম্পক উন্নয়ন, আত্মীয়তা, অতিথিপরায়ণতা ভুলে যেতে বসেছি? দুঃখ পেলেন, চলে গেলেন! না না! এমন তো নয়? হয় না! তাহলে কী অজান্তেই কষ্ট পেলন? চলে গেলন? অমল ছলছল নয়নে লাজুক সভাবের ছেলেদের মতো বালিশে মাথা গুজে নিল। আমি অমলকে ডাকতে গিয়ে পেছনে দিকে সরে এলাম। ভাবলাম, গত রাতে শান্তনার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। রেগে গিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে। হয়তো কোনো অভিমান!
আমি পাশে থাকা চেয়ারে নিঃশব্দে বসে রইলাম। এক হাতে চা, অপর হাতে পেপার নিয়ে উল্টাতে লাগলাম।
নাহ্! কেমন যেন শান্তি পাচ্ছি না। রুমের ভেতর মাত্র দুজন মানুষ। আমি চেয়ার থেকে ওঠে এসে অমলের কাছে গিয়ে বসলাম। পিঠে হাত রাখলাম। ও বাচ্চা ছেলেদের মতো উঠে দাঁড়ালো। আমার চেয়ারে গিয়ে বসলো। তখনও আনমনা ভাবটা কাটেনি। ওর চা টা ততক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি আরেক কাপ চা বানিয়ে দিলাম।
কৌতূহলবশত কিছু জিজ্ঞাসা করতেই অমলের বিমর্ষ থাকার ঘটনা বলতে আরম্ভ করল। এ বিষয়টি আমাকে এতটা অভিভূত করল যে আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। অমলের মত আমারও একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেল- ‘সত্যিই আমরা কি মানুষ আছি তো?’
⇒১
গল্পটা ছিল অমলের শেষ রাতের স্বপ্ন। খুবই আনন্দঘন ছিলো শুরুর দিকটায়। স্বপ্ন হলো খেলা, রঙ্গিন মাধুরী। স্বপ্ন একটা জাল, যা অবচেতনে মনুষ্যত্ব বা চেতনার বিকাশ ঘটায়। এমন একটি চেতনায় অমল দেখতে পায়- গ্রামের বাড়িতে সবাই এসেছেন। বড় ভাই, ভাবি, বোন-বোন জামাই, বাচ্চারা- সবাই। সবাই সবার মতো করে তাদের কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে সবারই আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে।
দুই ভাবি মিলে লুডু খেলছেন। ছোটবাচ্চারা হুড়ুহুড়ি করছে। ওরা একত্রে আমোদে মেতে উঠেছে। কেউ মুভি আবার কেউ নিষ্ফল গল্পে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ি জুড়ে রমরমা ভাব একটা! দূরসম্পর্কের একজন আত্মীয় যদিও বাস্তব রূপে কে বা কি হন তা অমলের জানা নেই। তবে, সে খুবই মজার মানুষ। বয়স সত্তরের মতো। পাকা আম বরণ। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি পড়া। বয়স সত্তর হলেও দাঁত গুলো ঝকঝক করছে। হাসিটাও ভুবন ভোলানো। স্বপ্নের ভেতরই অমল উনাকে কাকা বলে সম্বোধন করেছে।
তিনি বারান্দায় এসে বসেছেন। বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে কাছে ডেকে নিয়ে পকেট থেকে বাহারি রঙের চকলেট বের করে খেতে দিলেন। ওরা চিৎকার করে বললে ওঠলো- দাদু আর একটা দাও, আর একটা দাও। শেষে বাড়ির প্রায় সবাই তাঁকে দেখতে এলেন। হঠাৎ বড় ভাবী, সে খুব চঞ্চল। কাকু তাকে ডেকে বসালেন। একটা চকলেট হাতে নিয়ে বললেন, খেয়ে নাও! বড় ভাবি উৎসাহ ভরে যেই না কামড় দিলেন আর অমনি মুখটা কয়লার কালিতে ভরে গেল। মুহূর্তে একটা হাসির ঢেউ পড়ে গেল। অন্যদেরও মুখে ঠিক তা-ই হল। চকলেটগেুলো শেষে কাঠের কয়লা হয়ে গিয়েছে।
মূলত সেই আত্মীয় কাকা ছোটখাটো ম্যাজিক জানতেন।
বড় ভাবি পান এনে দিলেন। কাকু পান চিবুতে চিবুতে একটা গল্প বললেন। গল্পটা ছিল এমন, এক লোক তার স্ত্রীকে নিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে একটা মোটরসাইকেলে করে বখাটে ছেলেরা যাচ্ছিল। এমন সময় লোকটির স্ত্রীর ব্যাগ ধরে টান দিল। যেই না কিছুটা সামনে এগোলো, ঠিক চার রাস্তার মোড়ে সিগনালের জ্যামে পড়ল। মহিলার চিৎকার-চ্যাচামেচিতে পথযাত্রীরা এগিয়ে এল। পরিস্থিতি বেগতি দেখে বখাটে ছেলের দল মোটরসাইকেল রেখে ভেনেটিব্যাগ নিয়েই পালিয়ে গেল। উপস্থিত জনতা বখাটেদের মোটরসাইকেলটা উদ্ধার করে ওই লোকটিকে জব্দ করতে দিল। তখন ওই লোকটা রেগে গিয়ে বলল- ‘ম্যাঙ্গির-পু অহন বুঝবি লাভ কার বেশী-কম।’ এই শোনে সবাই হেসে উঠল।
⇒২
কী যেন অজানা টানে আত্মীয় কাকুর কাছ থেকে ক্রমে ক্রমে সবাই সরে গেল। যে যার মতো ঘরে গিয়ে দিব্বি হাসি মস্করায় মেতে উঠল। সর্বশেষ ছিল মিন্টু । সেও অতুলের ডাকে চলে গেল। কাকু একা বসে বসে পান চিবুতে লাগলেন। আর মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
ছোট ভাবী, আত্মীয় কাকুর সামনে দিয়ে বড় ভাবীর ঘরে যাচ্ছিলেন। তখন জিজ্ঞাস করলেন, বাড়ি থেকে কখন বের হয়েছেন। আত্মীয় কাকু উত্তর দিলেন- ফজর নামাজ পড়েই রওনা দিয়েছেন। বেশ বেলা হয়েছে। ছোট ভাবি মেজ ভাবির মাধ্যমে বিস্কুট আর পানি এনে খেতে দিলেন।
অমল বারবারই বলছে যে, ওর চোখের সামনেই সবকিছু ঘটছে অথচ সে এর জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। স্বপ্নগুলো হয়ত এমনই হয়।
বৃদ্ধ আত্মীয় কাকু কপাল কুঁচকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, উনি একটু যত্ন চাচ্ছেন, সঙ্গী চাচ্ছেন। ক্ষুধায় তার চোখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ভদ্রতা বসতঃ চুপটি মেরে বসে আছেন।
মেজ ভাবীর রুমে হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি। সবাই দৌড়ে ওই ঘরে গেল। ক্রিকেট খেলা চলছে। আমোদে তনমন সবাই। খেলার ফাঁকে ফাঁকে কানাঘোষা চলছে- বুড়ো চলে যায় না কেন? আর এমন জায়গায় বসেছেন যে সবারই চলা ফেরার ব্যাঘাত ঘটছে। এক পর্যায়ে ব্যাপারটা কানাকানি ছাড়িয়ে উচ্চস্বরে প্রকাশিত হল। অমল তখনো নির্বাক, নিষ্ক্রিয়।
ছোট ভাবী বড় ভাবীকে বললেন, আত্মীয় কাকু না খেয়ে এসেছেন। কিছু খাবার পানির ব্যবস্থা করে দেই? বড় ভাবী আর মেজ ভাবী ক্ষেপে ওঠে গড়গড় শব্দ করে বলে উঠলেন- ‘কিছু লোকই থাকেন যারা এমনই ঠেসা। আর বুড়ো হলে আরও ঢং বাড়ে। দিলেই লোভ হবে।’
পরের কথা বলার আগেই আত্মীয় কাকু মেজ ভাবীর দরজায় এসে হাজির হলেন। হয়তো এর পরে যে কথাটা মুখ দিয়ে বেরুত তা হয়তো সহ্য হবার নয়। কাকু অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে মৃদু স্বরে বললেন- ‘তোমাদের শ্বশুর যখন এই বাড়িটা গড়েছিলেন তখন তার সাথে আমিও ছিলাম। কোনো মজুরি নিয়ে নয়, ভালোবেসে শ্রম দিয়েছিলাম। এ বাড়ির প্রতিটি জায়গায় আমার ঘাম মিশে আছে। তাই ঘেঁষা, ঠেসা হয়ে স্মৃতি চারণ করতেই এসেছিলাম। এক পশলা বৃষ্টিই বলো আর ঝরে পড়া ফুলই বলো, সবটাই সমাদরের হওয়া চাই। অরণ্য হলো মায়া, আর গুছানো বৃক্ষ কেবলই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। মায়া নেই তাতে। শান্তি নেই। মানুষ নেই।
এ বেলায় অমল শক্তি পায়; কথা বলার মতো বল পায়। ততক্ষণে আত্নীয় কাকু উঠানের মাঝ অবধী চলে গিয়েছেন। অমল হাত তুলে কিছু বলার আকুতি-মিনতি করার আগেই আত্মীয় কাকু কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে হারিয়ে গেলেন। যাবার সময় শুধু বাঁ হাতের একটি অঙ্গুলি তুলে অভিসম্পাত দিয়ে গেলেন- ‘তোরা কুলাঙ্গার। আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলাম।’
⇒৩
–
একরাতের অমলের স্বপ্ন
তারিকুজ্জামান (তনয়)
১৯ মার্চ ২০১৮, ময়মনসিংহ
দ্বিতীয় সংস্করণ: ১১-০৭-২০২৫ খ্রি.