দৌবযোগ
দীপ্ত : কামাল তুই জানিস, আমার এক পরিচিতের বাবা সে গাড়ি ড্রাইভারদেরকে কী বলে ওয়ারনিং দিয়েছেন?
কামাল : কী বলেছেন? ওনার ওয়ারনিংটা আমাদের কাছে সিমপল হতেও পারে। আগে বল শুনি!
কবীর : আমি জানি উনি কী বলেছেন?
উজ্জ্বল : কী?
কবীর : কার স্টার্ট, সিগারেট স্টার্ট।
সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। কামাল কথাটাকে সম্মতি দিয়ে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে উদ্যত হলে পাশে বসা দীপ্ত হাত চেপে ধরে বাধা দিয়ে বললো – তোরা হাসিস না। উনার কথায় রিয়ালাইজেশন আছে।
কামাল : ধুর শালা, প্যাচাচ্ছিস ক্যান ? বলে ফেল না।
দীপ্ত: তিনি বলেছিলেন, যখন স্টেয়ারিং ধরবে তখন মনে করবে রাস্তায় চলা সকল মানুষ পাগল, উন্মাদ, বোকা। একটা দুর্ঘটনার ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে, তা তাদের বুঝের মধ্যে নাই। আর সেখানে তুমি ড্রাইভার হিসেবে একমাত্র সচেতন ব্যক্তি। সেক্রিফাইজ তোমার মূল মন্ত্র।
⇒০১
উজ্জ্বল : বাহ! বাহ! বাহ! এটা ন্যাচারাল। আসলে ব্যাপারখানা কী হয়েছে জানিস কামাল, যুগযুগ ধরে পণ্ডিত ব্যক্তির সাথেই আরেক পণ্ডিত ব্যক্তির সাক্ষাৎ হয়। বুঝলি, এতে করে পাণ্ডিত্ব বাড়ে।
কথা শেষ হতে না হতেই মধ্যবয়স্ক এক লোক জেব্রা ক্রসিং দিয়ে কোনো প্রকার সিগনাল না মেনেই বাম-ডান না তাকিয়েই সাইকেল চালিয়ে দিলেন। কামাল হন্তদন্ত হয়ে কড়া ব্রেক চেপে বসল। একটা বিরাট দুর্ঘটনা হাত থেকে সবাই বেঁচে গেল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সাইকেল চলক-এর কোনো কিছুই বুঝতেই পেল না। বুঝার চেষ্টা টা পর্যন্তও করলো না। তিনি যেমন করে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তেমন করে স্বাভাবিক ভাবেই চলে গেলেন।
কিছুদূর যাওয়ার পর একটা তেলের পাম্প চোখে পড়ল। এর মাঝে কামাল সিগারেট খাওয়ার একটা টান অনুভব করল। পাম্প থেকে তেল নেওয়ার পাশাপাশি কিছু অধ্যায়ও শেষ করা যাবে।
কামাল সিগারেট টানছে, এমন সময় ফোনে কল এল। খুবই বিরক্তি ভরে রিসিভ করল।
-হুম, বল। রাস্তায়। আসতেছি। না, যাব না। সময় হবে না। হুম, না, পসিবল না। এখন ড্রাইভ করবো, রাখছি।
কলটা কেটে দিয়ে আবার কল দিল।
⇒০২
-হাই! ওয়ান্ডাফুল সূর্যের বর্ণীল আলো গাড়ির গ্লাসে, আমার শরীরে, গজারি গাছের পাতায় পড়ে আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তুমি পাশে থাকলে উল্লাসটা অন্যরকম হতো। এমনকি ঝরা পাতার আওয়াজটাকেও মিস করতাম না। চাপা নয়, সত্যিই মিস করছি। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো। আচ্ছা, ঔষধ খেয়েছ?…আহ্! অনিয়ম করো না। আমাদের বংশের প্রদীপ…হা হা হা। হুম, দেখবো তখন, আমাকে আবার ভুলে যেয়ো না। হুম হুম। আচ্ছা রাখছি।
আবার যাত্রা শুরু হল।
কবীর : (উজ্জ্বল-কে) তুই গাছের তলে এক নম্বর করলি কেন?
উজ্জ্বল : ছেলে মানুষি চেপেছিল।
কামাল : ঘুরতে গেলে সবারই বয়স কমে যায়।
উজ্জ্বল: জানিস কামাল, আমার ছোট বেলায় গ্রামে কেটেছে। দর্জির কাছ থেকে বানানো কুঁচি করা সুতি কাপড়ের হাফ প্যান্ট পরতাম তখন। পাড়ার ছেলেরা মিলে লাইন ধরে দাড়িয়ে সিচু দিতাম। খালের পাড়ে লাইন ধরে বসে টয়লেট করতাম । সিপ দিয়ে পুটিমাছ ধরতাম।
কবীর : (উজ্জ্বলকে) কিরে, সে দলে বান্ধবীরা ছিল না তো?
⇒০৩
মুহূর্তেই হাসির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল।
দ্বীপ : আমরা তাহলে কয়টায় পৌঁছাচ্ছি?
কবীর : সন্ধ্যা হতে পারে।
উজ্জ্বল : সালা ত্যাড়া কথা ছাড়।
কবীর : ৮৫ কি.মি.। বড়জোর তিন ঘণ্টা লাগতে পারে। এটা জিগানোর কি আছে।
উজ্জ্বল : এক দিনের ট্যুর। সারাদিনের পরিকল্পনা বল তো।
কবীর : আগে পৌঁছা ব্যাটা।
কামাল : ময়মনসিংহ শহরে পৌঁছে প্রথম যে কাজটা করতে হবে তা হল ডাবল বেডের একটা এসি রুম নিতে হবে। তারপর ফ্রেশ হয়ে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে আনন্দ মোহন কলেজে যাব। পিন্সিপাল স্যার আমাদের ভার্সিটির বড় ভাই। আমার পরিচিত।
কবীর : হুম, কলেজে সকাল সকাল ঘুরতে যাওয়া টা ফাস্ট ক্লাস ডিসিশন।
উজ্জ্বল : মামু, বিয়ে করেছ, এটা আবার ভুলে যেও না।
কবীর : মাত্র একটা।
দ্বীপ : আরও ইচ্ছা আছে নাকি রে?
কবীর : মামু। ধর তোর বয়স পঞ্চাশ বছর। বউ টা মারা গেল। তখন বিয়ে করতে পারবি? ভায়্যা, সময় থকতে একের চেয়ে দুই ভালো।
⇒০৪
ঠিক ঠিক- বলে সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো।
কামাল : তারপর কে বি.। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
দ্বীপ : হুম শুনেছি অনেক সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
কামাল : শশী ল’জ এর রাজবাড়ী। এখানে একটা লোহার কুঠি আছে। তারপর মুক্তগাছা জমিদার বাড়ি দেখে ঢাকায় ব্যাক করব।
কবীর : আমাকে বন্যা কল দিয়েছিল।
কামাল : আমাকেও দিয়েছিল।
কবীর : দেখা করবি।
কামাল কিছু বলতে উদ্যত হল এমন সময়-
উজ্জ্বল : দেখ, দেখ জায়গাটার নাম কি চমৎকার।
দীপ্ত : চোর খাই। হিহি..
কামাল : আমরা একদম কাছে চলে এসেছি।
কামলের ফোনে কল এসেছে।
কামাল : হ্যালো সাইফ, বল।
কবির : কে, মামু নাকি? কি কয়?
সাইফ : কে! কবির মামু কণ্ঠ শোনা যায়।
কামাল : হুম। কি অবস্থা তোর, বল।
সাইফ : আমি ফাইনালি তোদের সাথে যোগ দিচ্ছি! আমি আছি, যাইনি।
কামাল : দ্যাট’স গুড। আমরা বাইপাস পযর্ন্ত। নে উজ্জ্বলের সাথে কথা বল।
উজ্জ্বল : দোস্ত, হবে নাকি?
সাইফ : দোস্ত, পাত্তা লাগিয়েছি। আয় আগে।
উজ্জ্বল : কম নিস না কিন্তু, বেশী লাগবে। অনেক দিন..।
দীপ্ত : কী, তোরা আজকেই ব্যাক করবি না?
কবির : জ্বি মামু।
⇒০৫
একটা হাসির মাতম পড়ে গেল। কামাল ফোনটা নিয়ে সাইফ কে বলল- ভালো হোটেলগুলো কোন দিকে রে?… হুম শুধু আজকের জন্য। জাস্ট ফ্রেশ হওয়া আর ব্যাগগুলো রেখে যাওয়া। না, অতো বেশি কিছু না। ফ্রেশ হওয়াটাই মেইন।..ট্রাংক পট্টি। হেরা হোটেল! ওকে।
কামাল একটু স্থির হয়ে গাঢ় কণ্ঠে আরও বললো– না, অহেতুক কেন? যাবো না। রাখছি।
উজ্জ্বল : এটা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ। বৃহত্তর ময়মনসিংহের চিকিৎসার ভরসাস্থল।
দীপ্ত : চলে এসেছি। কোথায় যেতে হবে বল।
কামাল : ওয়েট ম্যান।
পথচারী, রিক্সাওয়ালা, দোকানদার সবার সহযোগিতা নিয়ে হেরা হোটেলে পৌঁছাল। সাইফের সাথে সাক্ষাৎ; হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হওয়া হয়।
কবির : বয়সটা ধরে রাখা খুবই কঠিন, কী বলিস বন্ধু।
উজ্জ্বল : ওয়েল ইয়োর উন মেশিন, ম্যান।
দীপ্ত : কবির একটু বেশিই।
কবির : সুইট ডিয়ার, ঘাড়ের পিছনে শার্টের কলারে হলুদ তাগ লাগলো কেমনে? কলেজে যাচ্ছো—।
কামাল : ফাজলামু বাদ দে। চল এবার বার হওয়া যাক।
সাইফ : চল।
বনলতা, দীপ্তর স্ত্রী। দুটি বড় বড় হটপটে করে সকালের নাস্তা বানিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে চট করে খেয়ে নিলো। অবশেষে ওরা হোটেল থেকে বের হলো।
⇒০৬
কামাল : বাপরে বাপ। এটা তো রিকশা আর অটোর শহর। রাস্তাগুলো খুবই চাপা। ড্রাইভ করা কঠিন।
উজ্জ্বল : পুরাতন শহর। ব্রিটিশদের ভাগ করা দেশের ১৬ জেলার মধ্যে এটি একটি। ১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নাসিরাবাদ থেকে মোমেনশাহী হয়, পরে ময়মনসিংহ।
সাইফ : হুম। শহরে অনেক পুরাতন নিদর্শন আছে। আনন্দ মোহন কলেজটাও পুরাতন। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। যা আনন্দমোহন বসু নামক প্রখ্যাত গণিতবিদ যিনি ক্যামব্রিজ থেকে গণিতে অনার্সসহ ট্রাইপস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেন। যা একজন ভারতীয় হিসেবে প্রথম এই ডিগ্রি অর্জন। তার বাড়িতেই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত।
দীপ্ত : নিজের বাড়ি!
উজ্জ্বল : হুম, শেষ জীবন ভাড়া বাসায় থাকতেন।
দীপ্ত : আমাদের দেশে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের অবদানকে প্রশংসা করার জন্য আজও কোনো ভাষা আবিষ্কার হয়নি।
কামাল : এই তো চলে এসেছি।
উজ্জ্বল : কমপ্রোমাইজ, কমপ্রোমাইজ, কমপ্রোমাইজ।
সবাই হেসে উঠলো। এমন সময় সাইফের ফোন এলো।
⇒০৭
সাইফ : হ্যালো। হুম আছি। আনন্দ মোহনে। খেয়েছি। বলেছি। দেখি। দেখি, ট্রাই করবো।
কবীর : ‘ও, সে যে পিরীতি, কাঁঠালের আঁঠা।
এ আঁঠা লাগলে পরে ছাড়ে না।
গোলেমালে গোলেমালে পিরীত কইরো না।’
কার পার্ক করে নেমে প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষে গিয়ে দেখা করে নিল।
চমৎকার কারুকাজ করা রঙ্গিন কলেজভবন। ঘুরে, ছবি তুলে, স্যারদের সাথে কথা বলে আবার রওনা দিল- মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির দিকে। সাইফের পরামর্শে দিনের সিডিউল পরিবর্তন। ময়মনসিংহ থেকে মুক্তাগাছার দূরত্ব ১৫ কি.মি. হলেও ৩০কি.মি. এর পথের মত সময় লাগে।
কামাল : সাইফ, মণ্ডার দোকানটা কই রে?
সাইফ : গেটের প্রায় সামনেই। খুবই সুস্বাদু। জমিদার বাড়ির ইতিহাসের মত এর পুরাতন ইতিহাস রয়েছে। তখন শুধু জমিদারদের জন্যই তৈরী হতো।
কবির : আজ আমরা মণ্ডা খেয়ে জমিদারি ফিলিংস নিবো।
⇒০৮
উজ্জ্বল : ঠিক। নাচ্ সুন্দরি নাচ্। ঘুঙ্গর পরে ঝুন ঝুন শব্দে দুলিয়া দুলিয়া নাচ। কারুকার্যে শোভিত পিয়ালে সরাফ গিলে গিলে মাতাল নেশার ঘুরে হুক্কায়- নাচ্ সুন্দরী নাচ্। প্রতিটা টানে যৌবন ফিরে পেয়ে আবার চিৎকার- সুন্দরী নাচ্।
দীপ্ত : উজ্জ্বল, তোর গুণ আছে রে।
কবির : আছে, তবে মূর্ধন্য ণ ছাড়া।
মুখ চেঁপে হাসলেও দীপ্ত তার হাসি চেপে রাখতে পারলো না। আর তিন কি.মি পথ বাকি।
দীপ্ত : আরও তিন!
কামাল : মুক্তাগাছা। নামটা বেশ সুন্দর। মুক্তার গাছা । গাছা মনে- স্ট্যান্ড।
উজ্জ্বল : প্রকৃতপক্ষে মুক্তার গাছা নাম থেকেই এ জমিদার বাড়িটির নামকরণ করা হয়েছে। মুক্তারাম নামক একজন করিগর মুক্তা খচিত গাছা বানিয়ে জমিদারকে দেন। জমিদার এতে খুবই খুশি হন। অতঃপর জমিদার কারিগরের পার্থনা অনুযায়ী জমীদার বাড়ির পূর্ব নাম বিনোদ বাড়ি পরিবর্তন করে মুক্তাগাছা রাখেন।
সাইফ : পরে জমিদার বাড়ির নামানুসারে এলাকারটির নাম রাখা হয় মুক্তাগাছা।
সাইফের কাছে কল আসে।
⇒০৯
সাইফ : হুম, বল। এই তো মুক্তাগাছার কাছাকাছি। না, দেখি। দুপুরে। না না, হবে না হয়ত। দেখি। দেখছি। আচ্ছা, বাই।
অতঃপর ওরা জমীদার পৌঁছে গিয়েছে। লোভ সংবলণ করতে না পেরে প্রথমে মণ্ডা খেয়ে নিলো। জমিদার বাড়িটি বেশ ভঙ্গুর। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় বাড়িটি থেকে সবকিছু লুট হয়ে যায়। বাড়ির ভিতর টায় একটা মন্দির ছিল। মন্দিরটির নাম ছিল রাজেশ্বরী মন্দির। যার প্রমাণ ধ্বংসাবশেষের মাঝে এখনো তার প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান, যা কেবল মহারাজা ও রাণীদের পুজার্চনার জন্য ব্যবহার হতো। রিভলবিং নাচমঞ্চ ছিলো। পুরো জমিদার বাড়ি জুড়ে নৈপূন্যময় কারুকার্যে সুসজ্জিত।
ওরা সবাই ইচ্ছে মতো ছবি ও ভিডিও করে নিলো। আবার দিন শেষে ঢাকায় ফিরতে হবে। তাই ব্যাক করার একটা তাড়না সবার মাঝেই কাজ করছে।
এমন সময় কামালের বাসা থেকে আবার কল এল।
⇒১০
কামাল: হুম, রেশমি বলো। কেমন লাগতেছে? কেন, কেনো অস্বস্তি লাগে? ঘুম,ঔষধ,খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করেছো তো? আচ্ছা, তার পরেও? একটা গল্প শুনবে ? ভালো লাগতে পারে। আচ্ছা, ঠিক আছে। বলছি। ও হ্যাঁ, শোনো। গল্প শোনার সময় মাঝে মধ্যে হ্যাঁ-হুম বলতে হয়। ওকে বলি এবার। ‘গাছের মগ ডালে উপর পাখির নীড় ছিল। নেই নীড়ে এক জোড়া পাখি বসবাস করত। পুরুষ পাখিটি খাবার সংগ্রহের জন্য বাহিরে গেল। অনেক দূরে কোথাও গেল। সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো, কিন্তু পুরুষ পাখিটা ফিরে এল না। কোনো এক অজানা আসঙ্কা থেকে পুরুষ পাখিটা ফিরে আসার জন্য স্ত্রী পাখিটা শিশ্ দিতে থাকল।
বিকেল গড়িয়ে গেল। পুরুষ পাখিটা তবুও এল না। তখন আরও করুণ সুরে মমতা নিয়ে স্ত্রী পাখিটা ডাকতে থাকল।
যখন সন্ধ্যার আকাশে রক্তিম আলোর আভায় ছেয়ে গিয়েছে, চারিদিকে অন্ধকার প্রায় নেমে এসেছে, ঠিক তখনই পুরুষ পাখিটা তীর বেগে উড়তে এলো। আর সঙ্গে নিয়ে এল অনেকগুলো খাবার।
স্ত্রী পাখিটা পরুষ পাখিটাকে জিজ্ঞাস করলো- ‘আমাকে তোমার এক বারও মনে পড়েনি?’
উত্তরে- ‘প্রতিটা ক্ষণেই ব্যাকুল ছিলাম। এটা ভেবে পুরো দিন খরচ করে পুরো সপ্তাহের খাবার এনেছি। সপ্তাহের বাকি ছয়টা দিন আমাদের শুধু।’ রেশমি, কথা দিলাম আমি আর ঘুরতে যাবো না। টেক কেয়ার। গল্পটা কেমন লাগলো। ও, ভালো। মন খারাপ করে দিলাম? আচ্ছা। আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার রাখছি।
⇒১১
সাইফ : ভাবীর শরীর কেমন রে?
কামাল : ভালো। তবে দুশ্চিন্তা করছে।
কবির : একেই বলে যত দূরে তত কাছে।
কামাল : কপি পেস্ট করিস না দোস্ত।
দীপ্ত: হি হি হি
উজ্জ্বল : জারনিটা ক্ষ্যাপ মারার মত হলো। কোথাও বসে মনটাকে জুড়ানো গেলো না।
দীপ্ত : দু’টা বাজে। খিদা লেগেছে। সাইফ ভালো হোটেল কোথায়।
সাইফ : চল বন্যার বাসায় যাই। ও দুপুরের জন্য রান্না করেছে। কী বলিস উজ্জ্বল, যাবি?
উজ্জ্বল : না রে দোস্ত। রেড় এলার্ট আছে।
কবীর : আমার খাবারে লোভ আছে। তার উপর রূপসির হাতের।
সাইফ : অনেক করে বলেছে। আমি তোদের অনুমতি ছাড়াই বন্যাকে খাবার রেড়ি করতে বলে দিয়েছিলাম।
দীপ্ত : না, থাক। বাইরে খেয়ে নিব, যাবো না।
কামাল : এই মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির শেষ জমিদার ছিলেন জীবেন্দ্র কিশোর। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় তার ভোগকৃত আট আনি জমিদারি রেখে, অনেক ব্যবহার্য দামি জিনিসপত্র রেখে তিনি বড় বড় বই গুলো নিয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন।
সাইফ : এটাই ভাববার বিষয়।
দীপ্ত : ই-রে। সাইফ বন্যাকে বলে দে আসতেছি। কোনো খাবার ঠাণ্ডা যেন না হয়। ঠাণ্ডা হলে খবর আছে।
উজ্জ্বল : কামাল?
সাইফ : (ফোনে বন্যাকে) হ্যাঁ। হ্যালো। ইয়েস আসতেছি। একটা আইটেমও যদি টেস্টে কমতি হয়… তবে…।
কবির : কামাল, বিষয়টা আমাদের এভয়েড করলেই ভালো হতো।
⇒১২
এর পরের কথাগুলো,
সব কথার বা ঘটনার বর্ণনা করতে গেলে রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে যাবে। বিষাদে গাছের পতা ঝরে পড়বে। জীবনের কিছু ঘটনা থাকে যার কোনো উত্তর থাকে না। নির্বাক হয়ে থাকাটাতেই বোধয় উত্তম উত্তর লুকিয়ে থাকে।
সেদিন কামালের অন্তঃসত্তা স্ত্রী রেশমি, বাথরুমে পড়ে গিয়ে নির্মম ভাবে মৃত্যু বরণ করে। স্ত্রীর সাথে তার শেষ কথাটিও বলতে পারেনি। হাসপাতালে নেয়ার পথে ফিসফিস করে বলেছিল- আমার কামাল? কামাল?
সেদিন দীপ্ত, তার কথা রাখতে পারেনি। সময় মত ঢাকাতে পৌঁছাতে পারে নি। ময়মনসিংহ থেকে ফিরে এসে হাসপাতালে রক্ত দেয়ার কথা ছিলো। রক্তের অভাবে বন্ধুর বাবা হাসপাতালের বেডে মারা গিয়েছে। আসার পথে মাইক্রোবাসটি দূর্ঘটনার শিকার হয়। গাড়িটি এখন গাজীপুরে পুলিশ স্টেশনে আছে। ওরা সবাই অল্প আঘাত পেলেও উজ্জ্বল গুরুত্বর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছে।
এর আরও ছয় মাস পর,
কাউকে কিছু না জানিয়ে কামাল আবার ময়মনসিংহে গিয়েছিল। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বাসার কাছে এসে তিন রাস্তার মোড়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। পরিচিতের সহযোগিতায় হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে। বাবা মা’র যত্নে এইবারের মত শরীর সেরে উঠে।
⇒১৩
একদিন সকাল বেলা কবির আসে কামালের সাথে দেখা করার জন্য। কবির এসেছিল শান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। কামাল কবিরকে গভীর তিক্ততায় প্রশ্ন করে- ‘কখনও রেল লাইনে তামার পয়সা পিষ্ট হতে দেখেছ ? রেল আর লাইন দুটোই লোহা। তবে আমি কেন তামা হয়ে এর মাঝে পড়লাম। তবে কী ভাগ্য আমার সাথে খেলা করছে।’
আট মাস পর-
খুব ভোর বেলায় উজ্জ্বলকে দীপ্ত ফোনে কল দেয়। বলে, কামাল আর নেই। মারা গিয়েছে। বন্ধুরা সবাই ঘন্টা খানেকের মাঝে কামালের বাড়ি পৌঁছে গেল। শোনা গেল যে কয়দিন আগে রাস্তা পার হওয়ার সময় বাসের ধাক্কায় রাস্তার উপর পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়। তারপর জ্বর। বারো দিনের মাথায় কেউ কিছু বোঝার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। কে জানে সদ্য প্রয়াত রেশমির কাছে গেল, নাকি বন্যার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ হলো।
কামালের মৃত্যৃর কিছুদিন পরের কথা। কামালের ঘর গুছাতে গিয়ে ওর ভাগনি ঈশা বিছানার নিচ থেকে একটি ডায়েরি খুঁজে পায়। কয়েক জনের হাত ঘুরে ডায়েরিটা উজ্জ্বলের কাছে এসে পড়ে। সে ডায়েরিটা কেবল বিস্মিতই করেনি, সেই সাথে কিছু সত্য উন্মোচিত হয়েছে। কামালের তীব্র যন্ত্রণাগুলোও ফুটে উঠেছে।
ওই ডায়েরিতে নরম ভাষায় লেখা ছিল-
আমি হয়ত আর বাঁচবো না। মাথার তীব্র ব্যথা থেকে তারই ইঙ্গিত পাচ্ছি। ক্ষমা করো পৃথিবী, ক্ষমা করো আল্লাহ, ক্ষমা করো রেশমি। মাপ করে দিও মনের অন্তঃস্থল থেকে আমার বন্যা।
⇒১৪
পূর্ণ অধিকার দিয়ে ‘আমার’ বলতে পারি না। আমি তো মন জয় করেছিলাম শুধু। কিন্তু ওর দেহ, তিন তিন বার জয় করে নিয়েছে -ভিন্ন ভিন্ন পুরুষ। কবির বন্যাকে দেখে বলেছিল- শশী ল’জের বাড়িটির প্রবেশ দ্বারের সামনে থাকা ওই গ্রিক দেবীটি কী বন্যাকে দেখে বানানো হয়েছিল কি না? আমি তাকে কল্পনার/স্বপ্নের নারী বলে ডেকে থাকি। সে স্বপ্নের নারী হলেও আমি তাকে আমার করে পেয়েছিলাম। বাহুডোরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের দুজনের ভালোবাসার নৌকা পৃথিবীর মুখ দেখতে চেয়েছিল। বন্যা বলেছিল- মন দেয়া-নেয়া তো মিলন/বিয়েই। সে কখনও স্বীকৃতি চায় নি।
বন্যাকে আমি ঘরে তোলে নিব।
সেদিন ছিল শনিবার। বাবাকে বলতে গিয়েছিলাম, আমাদের এ সম্পর্কের কথা; আমাদের বিয়ের কথা; সামাজিক মর্যাদা আদায়ের কথা।
আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে বাবার রুমে ঢোকতেই আমাকে বাজে বাজে বকা দিয়ে অসম্ভব রকম প্রহার করতে লাগলেন। আমি চিৎকার করতেছিলাম, কাঁদতেছিলাম। আমার সাথে সাথে তারাও কাঁদতেছিলেন। অনেক কথার মাঝে একটা কথা বুঝতে পেলাম যে, আমি তাদের মান-সম্মান ধুলিসাৎ করে দিয়েছি। তারা মুখ দেখাবেন কেমন করে।
⇒১৫
আমার কোনো কথাই শুনছেন না। মার খেতে খেতে একবার আবিষ্কার করলাম রেশমিকে। রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে মা কাঁদতেছেন। ওই রুমে রেশমি ঢুকলে বাবা তখন রেশমির পা ধরে ক্ষমা চাইতে বললেন। -কি অপরাধ করেছিল ওর? ওর সর্বনাশ কেন করলি?’
ভেবেছিলাম বন্যার খবরটা বাড়িতে জেনে গিয়েছে। কিন্তু শেষে শুনি রেশমিও অন্তঃসত্তা। বাবা-মাকে বুঝাতে অক্ষম হলাম যে, আমি রেশমির হাতটাও কখনো ছুঁয়ে দেখিনি।
রেশমি আমার মামাতো বোন। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়তাম। বন্যাকে নিয়ে ঘটা সত্যটা আজ চাপা পড়ে গেল। অন্যদিকে রেশমি আর আমার ব্যাপারটা ক্যাম্পাস জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো।
রেশমির সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। অবশ্য বিয়ের কয়েক দিন পরই আমার মা বুঝতে পারেছেন যে প্রকৃতপক্ষে রেশমি অন্তঃসত্তা ছিলো না। রেশমির বানানো ঘটনাটা কেউ কেউ তাকে উচ্চাসনে বসিয়েছে আবার অল্প কয়েক জন ধিক্কার দিয়েছে। যাহোক, এতে রেশমির কিছু আসে যায় না। সে পেরেছে। পুরোটাই পেরেছে। জিতেছে।
বিয়ের তিন মাস পর রেশমির কাছ থেকেিই জানতে পারি, ও বন্যার অন্তঃসত্বার খবরটা জানতো। আর জানে বলেই এমন নাটক করেছিল।
⇒১৬
পরবর্তীতে বন্যার খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম, আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরই এক রিক্সা এক্সিডেন্টে প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়ে এবরশন হয়ে যায়। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বন্যা করেনি। এর কিছুদিন পর বিয়ে করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। কেউ জানল না যে নীরবেই তিনটি প্রাণের বিসর্জন হয়ে গেল।
কী অদ্ভূত ব্যাপার ছিল! আমি যখনই বন্যার কথা মনে করতাম, আর টিক তখনই রেশমির বিপদ হতো। কিছু না কিছু অলক্ষ্মী কিছু ঘটতোই।
ময়মনসিংহে গিয়ে বন্যাদের ওখানে খেয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সাথে বন্যাও ছিল। নদীর পাড় ঘেঁষা বৈশাখী চত্বরের সিঁড়িতে পাশাপাশি বসেছিলাম। আর ওরা, নদীর পার ধরে হাঁটতেছিল।
হাতে একটা মরা পাতা দোলাতে দোলাতে মনে উদয় হলো, এ তো আমারই বন্যা। এর পূর্ণ অধিকার শুধু আমারই। কাজল নয়না ও দু’চোখে চোখ রেখে সিক্ত নয়নে অধিকার করে নিতে চেয়েছি। সবে আমার হৃদয়ে পুলক জেগে উঠেছে। আর তখনই কল এলো। বললো, রেশমি আর আমাদের মাঝে নেই। মারা গিয়েছে।
খোদা আমি প্রায়শ্চিত্ত চাইনি। আমি তো সরল পথেই ছিলাম। তবে আমার এ কেমন অগ্নি পরীক্ষায় ফেললে?
⇒১৭
হ্যাঁ, আমি গিয়েছিলাম। রেশমি মারা যাওয়ার ছয় মাস পর ময়মনসিংহে আবার গিয়েছিলাম। হ্যাঁ! আমি বন্যা কে আনতেই গিয়েছিলাম। এর আগে ওর দুই দু’টি ঘর টিকে নি।
নাহ! পেলাম না। শেষ বারের মতোও পেলাম না আর। গিয়ে দেখি তৃতীয় বিয়ে করে স্বামীর হাত ধরে বর যাত্রীদের সাথে চলে যাচ্ছে। আমি চেয়ে দেখলাম শুধু। রিক্ত হাতেই সেদিন ফিরে এসেছি।
প্রার্থনা করি তোমায় খোদা। আমি আর পরীক্ষা দিতে পারবো না। এইবার মোরে অবসর দাও। আমি তোমার কাছে যাবো। আমি বড় ক্লান্ত আজ।
ক্ষমা করো।
কামাল
১৩ শ্রাবন’ ১৪২৫”
–
দৌবযোগ
তারিকুজ্জামান তনয়
জুলাই ২০১৮, ময়ম.