এহসান মামা

মা এসে বললেন- আজ তোমাদের এহসান মামা আসবেন।

এ কথা শুনে আমরা হুল্লোড় ধ্বনি দিয়ে উঠলাম। আমরা যৌথ পরিবার। এর মানে ডানা অনেক কিন্তু শরীর এক। বুঝলে না তো? আমার চার চাচ্চু। আমার চাচাতো-জ্যাঠাতো মোট এগারো ভাইবোন। আর দাদা-দাদি। আমরা সবাই এক সাথে থাকি। এক সাথেই খাই। আমাদের এক একটা দিন মানে এক একটা উৎসবের মতো।

আমাদের বাড়িতে একটা বৈঠকখানা আছে। থাকার ঘরগুলোর পরে এর অবস্থান। বৈঠকখানার সামনে একটা পুকুর আছে। আরেক দিকে ফল-ফুলের বাগান। 

আমার স্কুল বেশ দূরে। স্কুলের সময় হলে আমরা ভাইবোন মিলে এক সাথে স্কুলে যাই। কী যে মজা হয়! সাইফুল ভাইটা আমার খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। ফল অথবা কোনো ফুল গাছ দেখলেই সেখান থেকে কমপক্ষে একটা ফুল বা একটা ফলের অধিকার করা তার চাই, চাই-ই। এই নিয়ে বিপত্তিও কম বাধেনি।

এহসান মামা আমার সবচেয়ে প্রিয় মামা। মামা চকলেট দেন; নতুন নতুন টাকা দেন। আমরা অনেক মজা করি। আমার মামা দেখতেও অনেক সুন্দর এবং হাসি-খুশি। 

একদিনের একটা ঘটনা বলি- শুনো। আমরা বসে আছি। মামা এসে পাশেই বসলেন। আমার মামার কাছ থেকে মজার কিছু পাওয়ার জন্য বায়না ধরলাম। মামা স্বভাবসুলভ ভাবে রাজি হয়ে গেলেন। আর বললেন, এক জগ পানি ও দু’টো গ্লাস আনতে।

আমি দৌড়ে গিয়ে জগ ভর্তি পানি ও দু’টো খালি গ্লাস এনে মামার সামনে রাখলাম। এরপর মামা জগ থেকে পানি ঢেলে আমাকে, রবিন, বাবলু ও শায়লা কে খেতে দিলেন। আমরা পানি খেলাম। সেই পানির স্বাদ অন্য সাধারণ পানির মতোই লাগলো।

মামা বললেন- ‘আমি ম্যাজিক করে পানির স্বাদ মিষ্টি করে দিতে পারি।’

মামার এমন কথা শুনে আমাদের মাঝে উৎসাহ বেড়ে গেলো। তখন আমরা এহসান মামার চারপাশটা ঘিরে ধরলাম। 

মামা অন্য আরেকটা গ্লাসে পানি ঢেলে নিলেন। এমন সময় শায়না কাকিমা এসে উপস্থিত হলেন। শায়না কাকিমার বিজ্ঞান বিষয়ে বিস্তর পড়ালেখা আছে। ম্যাজিক যে একটা ভেলকি, তা আমরা বিভিন্ন ভাবে জানতে পেরেছি; কিন্তু এর সত্যতা কখনো প্রমাণ করতে পারিনি। তবে লোকমুখে শোনা হয়েছে অনেক বার। তাই যাদু যে ভেলকী তার প্রতি বিশ্বাস চলে এসেছে।

পৃষ্ঠা-০১

 

এহসান মামার চালাকি ধরে ফেলার জন্য শায়না কাকিমাকে এহসান মামার সামনে বসার জায়গা ছেড়ে দিলাম।

এরপর এহসান মামা দুই হাত একবার পেছনে নিলেন। একবার মাথার উপরে তুলে প্রার্থনা করলেন, একবার বুকের মাঝে রাখলেন। এরপর বেশ কয়বার অতি দ্রুত পেছনে, উপরে, বুকের মাঝে নিতে নিতে হাত নমষ্কারের আদলে শক্ত করে চেপে ধরলেন।

“যন্তর মন্তর সু; সবগুলোর চোখ অন্ধ-হু!

দাও দেখা, দাও ধরা এদের মাঝে কোন জন পাজি,

তার ঘাড় ভেঙ্গে দাও কটর মটর ছাড়ি!

যা যা বদলে যা…যমপুরের বুড়ি;

আক্কাস-পাক্কাস, জগতের সকল জল

হয়ে যাহ- মিষ্টি!

এই মন্ত্র পাঠ করে দুই হাত গ্লাসের উপর এনে তালি দিয়ে সরিয়ে নিলেন। আমাদের মাঝে হাসির আর কৌতূহলের এক অনন্য মিশ্রণ তৈরি হলো।

এরপর এহসান মামা শায়না কাকিমাকে গ্লাসের পানি চামচ দিয়ে নেড়ে নিতে বললেন। শায়না কাকিমা এহসান মামার এমন ম্যাজিক দেখে হাসতে হাসতে ঢলে পড়লেন। শেষে গ্লাসের পানি চামচ দিয়ে নেড়ে নিলেন। গ্লাসের পানি নেড়ে নেওয়া শেষ হয়ে গেলে এহসান মামা কাকিমাকেই প্রথমে খেয়ে নিতে দিলেন– স্বাদ কেমন তা জানাতে বললেন।

‘আহ! কী মিষ্টি।’- বলে শায়না কাকিমা লম্বা সুরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

এরপর বাবলু, শায়লা, ঘুরে আমিও খেয়ে স্বাদ নিলাম। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, সত্যিই গ্লাসের পানি মিষ্টি হয়ে গিয়েছে। পূর্বের মতো পানির স্বাভাবিক স্বাদ আর নেই।

অতঃপর আমরা আমাদের ঘরে ফিরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার বিকেল বেলাটায় বৈঠকখানায় ফিরে এলাম। যারা বয়সে ছোট, তারা পাশের বাগানে খেলতে গিয়েছে। সেখানে ছোটদের দল থেকে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছে। আমাদের এ বৈঠকখানাতেও হাসি-তামাসার কোনো কমতি নেই। ঐ তো যা হয় আর কি, যখন আলাপের কোন নির্দিষ্ট বিষয় বস্তু থাকে না, তখন  ‍পুরো বিশ্বটাই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে।

পৃষ্ঠা-০২

 

এমন সময় আমাদের বৈঠকখানায় এহসান মামা এসে হাজির। আমাদের মুখের প্রসন্ন হাসিটা একটা চিৎকারে উড়ে গেলো। আমাদের মুখ থেকে লম্বা সুর ভেসে উঠল- ‘মামা, ম্যাজিক দেখান।’

এহসান মামা বেদীর উপর বসলেন। মামার বয়স হয়েছে। মাথার চুল হালকা সাদা পাক ধরেছে। গোলাপী গায়ের রঙ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরা। মোটের উপর একটা ভালো লাগা সৌন্দর্য তার আশপাশটায় ঘিরে ধরে আছে। 

মামা, তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে এক পোটলা চকলেট বের করলেন। আমরা ভাবলাম, উপস্থিত সবাইকে দেওয়ার জন্য বের করেছেন। কিন্তু না! মামা বললো- ‘যে উত্তর দিতে পারবে, এ চকলেটের পোটলা তারই।’

এ কথা শোনে সবাই বললাম- ‘না মামা, না না, তা হবে না। চকলেটগুলো কোনো শর্ত ছাড়িই দিতে হবে।’

মামা কিছুতেই তা দিতে রাজি হলো না। মামাও আমাদের মতোই ছেলেমানুষি করতে লাগলেন। শেষমেষ, আমরা মামার কথাতে রাজি হয়ে গেলাম। এবং জিজ্ঞেস করলাম- ‘কী সেই প্রশ্ন?’

মামা প্রশ্ন করার আগে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিলেন। যেমন-

-উত্তর দিতে পাঁচ সেকেন্ড এর বেশি সময় নেওয়া যাবে না।

-সঠিক বানান এবং উচ্চারণ ঠিকঠাক হতে হবে।

-একবারের বেশি উত্তর কাটা গ্রহণযোগ্য নয়।

-একাধিক জনের সঠিক উত্তর হলেও, যে আগে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে তাকে প্রথম হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হবে।

-নিজে হাসলে বা অন্যকে হাসাতে প্ররোচিত করলে তার প্রার্থীতা বাতিল হবে।

-তর্ক বা ঝগড়া করলেও প্রার্থীতা বাতিল হবে।

এছাড়াও আরও কিছু শর্ত দিলেন, যেগুলো পালন করা খুবই সহজ। আমিসহ সবাই উৎসাহের সাথে রাজি হয়ে গেলাম।

মামা বললেন- ‘ উচ্চারণ ও বানান ঠিক হওয়া চাই। তবেই পুরস্কার।’

মামার এমন ঘোষণাতে সাবাই খুশি। বানানে আমার বেশ দখল আছে। তাছাড়া আমরা ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজন একত্রিত হলে নামের কলি, গানের কলি, ফুলের কলি, বানান নিয়ে খেলা করে থাকি। সেখানেও কত কঠিন কঠিন বানান নির্ভুলভাবে করে থাকি। আমি কণ্ঠ সরগর করে নিলাম। আমরা সবাই আরও প্রস্তুত হয়ে বসলাম।

পৃষ্ঠা-০৩

 

এমন সময় মা আর শায়না কাকীমা এসে উপস্থিত হলেন। মামা শর্তগুলো পুনরায় বলে শায়না কাকিমাকে প্রতিযোগিতায় যোগ করে নিলেন। শায়না কাকীমা আমাদের মতো মামার সামনে জটলা করে বসালেন। 

মামা এবার চিৎকার করে বিশেষ সতর্কতা ও একই সময়ে এবং একই সাথে শুরু করার জন্য অংক জাহির করতে লাগলেন। যেই না তিন অংক পার হলো, তখনই মামা কৃত্রিম কাশি দিয়ে আসরকে আরও জমিয়ে তুললেন। আমরা চিৎকার চেঁচামেচি করে দৃঢ় প্রতিবাদ জানালাম।

মামা এবার প্রতিবাদের মুখে পড়ে আবার অংক ডাকতে লাগলেন। আমরা সবাই তীব্র মনোযোগের সহিত মামার সেই প্রশ্ন শোনার জন্য তন্মন করছি। ঠিক তখনই মামা তিন বলা শেষ করে চেঁচিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে উঠলেন- ‘বানান করো- বল (বি.দ্র: এ বল মানে খেলার বল)।’

আমি, শায়লা কাকিমা, রবিন, বাবলু, সবাই চিৎকার করে ফেটে পড়লাম- ‘মামা ব-ল।’

মামা আরেক চিৎকারে বলে উঠলেন- ‘বলেইছি তো! তোমরা বানান করো বল।’

এই শোনে আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়লাম। আমরা মানি না। আমরা উত্তর করেছি। বল বানান করেছি। ব-ল।

মামা ঘোর আপত্তি জানালেন। মামা বললেন যে- ‘আমি বলেছি বল অর্থাৎ খেলার বল। আর তোমরা সবাই কিছু বলতে বলছো। আমি তো বলেইছি। কিন্তু তোমরা বারবার বলতেছো কিছু বলার জন্য।’

না আমরা কেউ মানি না। মানবো না। 

আমার মা এহসান মামাকে বললেন যে, আমরা সঠিক বানান ও উচ্চারণ করেছি। 

কিন্তু মামা, তা কিছুুতেই মেনে নিলেন না। মামা, চকলেটের পোটলা পুনরায় পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে নিলেন।

আমাদের সবার মন খারাপ হলো। যে যার মতো যুক্তি-তর্ক খাটাচ্ছি। আমাদের মাঝে আবার বেশ কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে হয়ে গেল। কেউ বললো, মামা ঠিক; আবার কেউ বললো, আমরাই ঠিক। আবার কেউ বললো, দুটোই ঠিক।

আবার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে চকলেটের পোটলা বের করে মামা বললেন- ‘আরেকটি বানান ধরবো। যে পারবে, এ চকলেটের পোটলা তার।’

মামার ফাঁদে আমরা আর পা দিবো না। তাই খেলায় অংশগ্রহণ না করার পক্ষে সম্মত হলাম। কিন্তু শায়না কাকীমার অনুরোধে আবার আমরা অংশগ্রহণ করলাম।

এহসান মামা এবার বেশ কিছু চটকদার কথা ছাড়লেন। আমরা সবাই পেছনের গ্লানি ভুলে গেলাম। মামার সম্মুখে আবার জটলা বাঁধালাম। এহসান মামা আবার অংক ডাকতে লাগলেন। এবং শেষমেষ চিৎকার করে সেই শব্দটা উচ্চারণ করলেন এবং আমরা তার সাথে সাথেই চিৎকার করে বানান বলে উঠলাম- মামা, হ-য-ব-র-ল।

এহসান মামা আবারও চেঁচিয়ে বলে উঠলেন- ‘হয়নি! হয়নি!’ 

পৃষ্ঠা-০৪

 

তারিকুজ্জামান তনয়

০৪ঠা মার্চ’২০২৪

শেওড়া পাড়া, মিরপুর, ঢাকা। 

 

বুনোপুষ্প

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments