লেখক

আজ(১৮-০৯-২০২৫) প্রকাশ করা হয়েছে। পৃষ্ঠা- ১৪ 👇💥
সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চাল বেয়ে বৃষ্টির পানি কাঁচা ঘরের পিঁড়ে ঘেঁষে পড়ে টিপটিপ ছন্দ তুলছে। কাঠের চেয়ারে এলিয়ে বসে হিম হাওয়া উপলব্ধি পূর্বক লেখক সেই বৃষ্টির ছন্দে মনের মিতালী মিশিয়ে এক অদ্ভুত রকম আনন্দ উপভোগ করছে। এহেন পরিবেশে তিনি একটি কবিতা সাজাতে উদ্যত হলেন। গ্রামে বসবাস করা মানুষগুলোর সহজ সরল ভাবনাগুলো, ব্যবহার, আতিথেয়তা, শ্রদ্ধাবোধ এবং গ্রামের মনোরম প্রকৃতিক পরিবেশ সহ সবকিছু নিয়ে একটা কবিতা সাজাতে চেষ্টে করছে।

শহরের মানুষগুলো মানুষের সাথে সাথে ধাক্কা খেলেও পরস্পরের সাথে কথা বলতে চায় না কিন্তু গ্রামে তার উল্টো। গ্রামের মানুষগুলো কোনো অপরিচিত কাউকে দেখতে পেলেই হাজারো জেরা করতে করতে এমন পরিস্থিতি করে ফেলে যে একাকিত্বে সময় কাটানোর মত সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে যারা গ্রামে আসেন না বা তাদের আসা হয় না এদের বেশির ভাগের বেড়ে ওঠা গ্রামে।

লেখকের দশম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামেই কেটেছে। বর্তমানে শহরে যাদের জন্ম তাদের শৈশবটায় গ্রামের দুরন্তপনায় বেড়ে উঠা। তখনকার সময়ে গ্রামের ছেলেদের দুরন্তপনা দেখে এখনকার শহুরে মায়েদের গায়ে জ্বর উঠে যেত। খালি গায়ে ধুলোর পরে লুটোপুটি, বর্ষাকালে কাঁদামাটি মেখে বিকৃত চেহারা, শীতে মজা পুকুরে শ্যাওলা পানিতে ঝুপঝাপ ডুব দেওয়া। বোরো ধান কাঁটা হলে বিস্তীর্ণ মাঠে গোল্লাছুট, ফুটবল, গারো-গোদন সহ আরও কত কি!
গ্রাম হল নাড়ি, মায়া। গ্রামগুলোতে রংয়ের মাখামাখি। গ্রাম উদার। গ্রাম হল প্রিয় বন্ধুর মতো। গ্রাম মৃদু-মন্দ সুবাসের আকর। গ্রাম জীবন বাসনার শেষ মাটি। গ্রাম সবার ভালোবাসা। আমরা সবাই ভালোবাসি। বাঁচতে চাই গ্রামের সুবাস নিয়ে; আবার লুকাতে চাই এরই কোনো শস্যক্ষেতের পাশে; মাটিতে।
স্বপন, লেখকের বন্ধু। একটি গল্প লিখতেই লেখক স্বপনদের গ্রামের বাড়ি এসেছে।
স্বপন পাশে এসে দাঁড়াল এবং বলল- “কী নিয়ে ধ্যানে আছো বন্ধু।”
লেখক- “স্বপন, এসো, বস।”
স্বপন- “আজকের দিনটাই মাটি হয়ে গেল। এমন বৃষ্টিতে গ্রামের চেহারা যা দাঁড়ায় তা ভদ্র লোকের জন্য জাহান্নাম তুল্য। অবশ্য তুমি লেখক মানুষ। ধ্যানী, সৃজনশীল মানুষ। ভালোই লাগছে হয়তো।”
লেখক- “ধ্যানে তো বটেই। তুমি ঠিকই বলেছ। ও কে?”
স্বপন- “তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে এলাম। ওর নাম মিলি। আমার মামাতো বোন। অনার্স শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বাইরে যাবে।­­”
পৃষ্ঠা- ০১

 

লেখক- “ভালো।’’
স্বপন- “দোস্ত! এবার তোরা কথা বল। শোন, তোর আসার সংবাদ পেয়েই মিলি গতকাল রাতে চলে এসেছে। ওর সাহিত্যের প্রতি আলাদা একটা ঝোঁক আছে।”
মিলি- “আমি আপনাকে ভাই বলেই সম্বোধন করব? আপত্তি..?”
লেখক- “আহা! তা থাকবে কেন? সবচেয়ে সহজ ও মধুর ডাক হল ভাই। আমি কিন্তু তোমার নাম ধরে ডাকব!”
মিলি- “অবশ্যই। স্বপন ভাই আমাকে নাম ধরেই ডাকেন। স্বপন ভাইকে ভাই বলে ডেকে থাকলেও আমি কিন্তু আপনাকে নাম ধরে ডাকতে পারি।
লেখক- “তাই নাকি? কেন?”
মিলি- “এর কারণ হল– কেউ বড় হলে, সম্মানিত হলে তাঁকে ছোট-বড় সবাই নাম ধরে ডেকতে পারে।”
লেখক হেসে উত্তর দিল- “তবে বেশ! তাই ডেকো।”
লেখক স্বপনকে সম্বোধন করে বলল- “বোনটি বেশ লাস্যময়ী।”
আপাত দৃষ্টিতে মুখে যশ থাকলেও মিলি তার অন্তরের ঝাল মেটাতেই লেখকের সাথে দেখা করতে এসেছে। লেখকদের প্রতি মিলির একটা নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। প্রতিটা মানুষ তার জীবনকে একটা ছকের মধ্য দিয়ে চালিয়ে থাকে। এটা করলে ওটা হবে। অথবা ওটা না করলে এটা হবে না। এই তো জীবন । এটা সোজা বক্তব্য। তবে লেখকদের লেখার রসদ সংগ্রহের জন্য তাদের কেন প্রেম করতে হয় বা প্রেমে পড়তে হয়? কিংবা নানা সং এ সাজতে হয়?
এছাড়াও মিলির আরও অনেক কিছু বিষয়েই হাস্যকর মনে হয়। বিয়ে হলে বাচ্চা হবে। বাচ্চা হলে খেতে দিতে হবে। খাবার রোজগারের জন্য পিতা-মাতার পরিশ্রম করতে হবে। এই, ঠিক এই-ই লিখলেই চলে। লেখকদের নানান বাড়াবাড়ি দেখে মিলির খুব রাগ হয়। এমন আরও প্রশ্ন নিয়ে মিলির বহুদিন ধরে প্রতীক্ষায় ছিল। অবশেষে সে একজন লেখক-কে খোঁজে পেয়েছে। তাই মিলি পণ করে এসেছে, এবার সে লেখককে জবরদস্তি করেই ছাড়বে।
মিলি- “চা খাবেন।”
লেখক- “চুপ থাকতেই ভালো লাগতেছে। তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও।”
মিলি- “আপনি কি করে বুঝলেন?”
লেখক মুচকি হেসে নীরব রইল।
মিলি বলল- “আচ্ছা, এবার বলুন তো– আমি কি প্রশ্ন করতে চাই?”
লেখক- “সেটা বলতে হলে পিছনের অনেক কিছু জানতে হবে। তবে মাথায় বিরাট একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে, এটা নিশ্চিত। তুমি তো জানোই, তোমার মনকে বিষিয়ে তুলছে গুটি কয়েকটা প্রশ্ন বা যুক্তি। বলে ফেল, কি প্রশ্ন করতে চাও?”
মিলি- “আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। গতকাল বিকালে শুনতে পেলাম একজন লেখক মামার বাড়ি মানে স্বপন ভাইদের বাসায় আসবেন। তাই কালক্ষেপণ না করে রাতেই চলে এসেছি। লেখকদের সাথে কথা বলার ইচ্ছা বহুদিনের।”
লেখক- “কৌতূহলটা বেশ শক্ত বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা! এখন চা হলে মন্দ হয় না।”
মিলি- ‘‘আচ্ছা।’’
পৃষ্ঠা- ০২

সাধারণত সবাই, আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির কণাকে, ঝর্ণার ধারাকে এমনকি চোখের জলকে বেদনার প্রতীক হিসেবেই প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু এর আড়ালেও একটা আনন্দ থেকে যায়। আর একই বিষয়ের প্রতি শ্রেণি ভিত্তিক আলাদা আলাদা প্রভাব বা আমেজ থেকে থাকে। বৃষ্টির দিনগুলোতে শ্রমিকদের জীবন যেমন হয় অভাবনীয় কষ্টের, ঠিক তেমনি জমির মালিক যারা এর আগেই ফসল ঘরে তুলে নিয়েছেন, তাদের মুখে থাকে হাসি। তেমনি জেলেদের মনে থাকে খুশির আমেজ। সৌখিদের জন্য বৃষ্টি হয় উপভোগ্যের। আর লেখকদের জন্য হয় ভাবনার/দর্শনের।
ইতিমধ্যে মিলি র’চা নিয়ে উপস্থিত ।
মিলি- “চা কেমন হয়েছে মন্তব্য চাই।”
লেখক- “এমন বাজে চা জীবনে একটিও খাইনি।”
মিলি- “প্রশ্নের উত্তর ভুল। দশ এ শূন্য পেয়েছেন। সঠিক উত্তর দিলে বোনাস নম্বর পেতেন।”
লেখক- “আমরা বাঙ্গালী, তাই বোনাসের প্রতি লোভ রয়েছে। চা-টা সত্যিই অসাধারণ হয়েছে। প্রতি চুমুকেই তৃপ্তির স্বাদ পাচ্ছি। এই দেখ, শেষ অবধি পান করে নিয়েছি। এমন সুন্দর মুহূর্তে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সেই সাথে তোমার জন্য একটা পুরস্কার আমার কাছে জমা রইল।”
মিলি- “গরম গরমের প্রতি আমার একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে।”
লেখক- “উপহার বাসি হোক তা আমিও চাই না।”
মিলি- “বোধগম্য হলো না।”
পৃষ্ঠা- ০৩

 

লেখক  উঠে গিয়ে রুম থেকে একটা কাগজ নিয়ে এল। কাগজের উপরের অংশে আঁকা ছিল- গাছপালা, একটি আঁকা-বাঁকা বয়ে চলা কাঁচা রাস্তা, দু’টু মানুষ, বাঘ, হাতি ও বন জঙ্গল। আর এর নিচে হাতে লেখা একটি কবিতা। কাগজের উপরে আঁকা ছবির পাশে অতি যত্নে কলম দিয়ে লিখে দিল-
‘উৎসর্গ,
প্রাঞ্জলা রূপসী মিলি-কে।’
মিলি উপহার হাতে নিয়ে বলল- “টাটকা পুরষ্কার পেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত।”
এবং লেখকের আবদারের পরিপ্রেক্ষিতে মিলি নাটকীয় ভঙ্গিমায় কবিতাটি আবৃত্তি করা শুরু করে দিল-

পথ

 মুণ্ডুর উপর তুলোর বস্তা,

ছেলের হাতে ধরে চলল রাস্তা।

ঈষৎ কাঁদা পথে– জুতো নাই পায়ে,

আকাশে রোদ দেখে– প্রফুল্লে হাসে।

বিরাট বস্তা দেখে ভাবে ছেলে মনে মনে,

মস্ত বড় জওয়ান– আমার-ই বাপে।

হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘ ডাকে!

ছেলে, অজানা আশায় নাচে;

আর বুড়ো–অশনি আশঙ্কায় কপালে ভাঁজ তুলে।

মাড়িয়ে পথ– ক্ষিপ্র বেগে ধায় বুড়ো!

এ কি লিলা–

মুহূর্তে আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন, আর বাতাস উড়ায় ধূলো।

গাছের শিকড়ে লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় বুড়ো,

আর ওধারে তুলো!

গগন ফাটানো চিৎকারে করে ওঠে ছেলে,

উড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বুড়ো।

এর কয়েক হাত দূরে সর্প দেখে বুড়ো,

ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে– ভয় পেয়ো নাকো!

আবার তুলোর বস্তা লয়ে চলে কিছু সামনে,

হঠাৎ রাস্তার উপর বাঘ এসে দাঁড়ায় আপন গর্জনে।

বাঘ তাকায় আগুন বর্ণে,

বুড়ো তাকায় আরও ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে।

হঠাৎ বজ্রের বিকট আওয়াজে

বাঘ দৌড়িয়ে পালায় দিকবিদিক ছুটে।

বুড়ো আর ছেলে প্রাণপনে ছুটে–

আর কোনো দিকে নাহি চেয়ে।

এবার বাঁচাও, এবার বাঁচাও– জপে জপে;

বাড়িতে পৌঁছাতেই গগনে রোদ উঠে হেসে।

ছেলে কহে ভয়ার্তে- আর নাহি যাব ও পথে!

বাবা হেসে কহেন- তবে শোনো, ও পথ চিনবে কেমন করে?

পৃষ্ঠা- ০৪

 

মিলি- “আমি কিন্তু বুড়োর দলে।”
লেখক- “বোধগম্য হলো না।”
মিলি- “আমি ওই পথকে চিনতেই চাই।”
লেখক- “বুঝিয়ে বললে সুবিধা হয়।”
মিলি- “আমি আপনার প্রেমে পড়তে চাই। আর আপনি আমাকে পটাবেন।”
মিলির এমন মন্তব্যে লেখক উচ্চস্বরে হেসে উঠল। এমনকি সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। মিলির দিকে ঝুঁকে গিয়ে লেখক বলল- “পৃথিবীতে হরেকরকম  মজা আছে। তান্মধ্যে এটি অন্যতম- অবাস্তবকে সবসময় বাস্তব হিসেবে দেখা।”
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মিলি আবার বলল- “আমি প্রেমে পড়তে চাই। আর সেই ব্যক্তিটি একমাত্র আপনি।”
লেখক- “ওই গানটি শোনা হয়নি বুঝি, যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়।”
মিলি- “বহুবার শুনেছি। তবে আমি রসায়নে বিশ্বাস করি। সেই সাথে লেখককেও। তাই আপনাকেও।”
লেখক- “দাঁড়াও-দাঁড়াও, বিষয়টা বুঝেছি। কিন্তু তোমার এ চাওয়াটা বেশ গোলমেলে লাগছে।”
মিলি আবার দৃঢ়ভাবে উত্তর কাটল- “এ তো খুবই সোজা কথা। আমি আপনার প্রেমে পড়তে চাই।”
লেখক- “বুঝিনি! কথাটা মাথার উপর দিয়ে গেল।”
মিলি- “আমাকে প্রেমে ফেলবেন, আর আমি আপনার প্রেমে পড়ব। ব্যাস!”
লেখক স্পষ্টতই বুঝেছে যে, সে একটা বিপদে পড়তে  যাচ্ছে। লেখকদের সম্পর্কে মিলির একটা বিশেষ কৌতূহল রয়েছে। লেখক ভাবল, কোনো ভাবে কেটে পড়বে নাকি একটু বাজিয়ে দেখবে। মিলির দৃঢ়তায় এটা পরিষ্কার যে, লেখককে হেনেস্তা করার ফন্দি ভাঁজতেই এসেছে। লেখক পণ করল, কোনো ভাবেই পিছু হটা চলবে না। এর শেষ দেখা উচিত।
লেখক কি যেন ভেবে হাসলেন। মিলি অনড় এবং নিজ অবস্থানে রয়ে গেল। লেখক কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি না হলেও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় স্বপন আবার এসে বলল- “দুস্ত। চল্ খাবে। মিলি চল্।”
কিছুটা হাফ ছেড়ে বেঁচে গেলেও লেখকের মনে কোনো একটা বিষয় ঘুরপাক খেলে চলল। ফ্রেশ হয়ে সবাই খেতে বসল।
পৃষ্ঠা- ০৫

 

একটা বিষয় বাদ পড়েছে। লেখকের বন্ধু স্বপনের পরিবারে রয়েছে তার বাবা-মা আর এক বোন। বোন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ও আসতে পারেনি । ওর বাবা-মা দু’জনেই বন্ধু সুলভ মানুষ। স্বপনের এনগেজমেন্ট হয়েছে। এখনো নতুন বউকে ঘরে তুলে আনা হয় নি।
স্বপন- “বন্ধু আমার খালাত বোন কিন্তু ভয়ানক দুষ্ট। আশা করি এরই মধ্যে কিছুটা বুঝতে পেরেছ।”
লেখক- “পুরোটা বুঝতে সময় লাগবে। আমি লেখক হিসেবে পথ শেষ না হতেই মন্তব্য করতে পারি না।”
ওদের অট্ট হাসিতে ঘরটা মোহিত হয়ে উঠল।
স্বপনের বাবা- “বাবা, তোমার বউ আর মেয়ে কেমন আছে?”
লেখক- “সবাই ভালো। অফিস আবার লেখালেখি। তাই সময় দেয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে কিছুটা। মেয়ে বুঝে না, তাই কাঁদে। আর বউ বুঝে তাই ঝগড়া করে।”
স্বপন মুচকি হাসল। বাহিরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে রোদ উঠেছে। স্বপন ও লেখক দু’জনেই খাবার খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে গিয়ে বসল। ‘বিয়েতে লজ্জা নেই’ এমন বিষয় নিয়ে মজার মজার কিছু অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান হল।
লেখক একপর্যায়ে বলল- “বিয়ের দলিল এমন একটা ব্যাপার যে, যেখানে একটি মেয়ের পূর্ণ অধিকার অর্জন করা হয়। দলিলে স্বাক্ষর হওয়ার পূর্বেই যদি তার হাত ধরা হয় তাহলে তখন নির্ঘাত মান হানি মামলায় পড়তে হবে। কিন্তু স্বাক্ষর হয়ে গেলে ঢাকঢোল পিটিয়ে দু’জন কে এক রুমে প্রবেশ করানো হয়। কি মজা আর কি ভয়ানক। উফ! তারপর সারাজীবন একসাথে কাটবে। এটাই হল নিয়তি, নিয়ম। শান্তি।”
তার লাজুক বন্ধুটির মুখটা লাজে লাল হয়ে উঠে শুধু ঠোঁট চিরে ঝকঝকে দাঁত বের করে করে হাসলো। বিয়ের ক্ষেত্রে, বিয়ের আগেও প্রার্থনা করতে হয়, একই ভাবে বিয়ের পরে শান্তির জন্যও প্রার্থনাতে লিপ্ত থাকতে হয়। বিয়েটা মূলত পরিস্কার পাত্রে দুধ রাখার মত। অপবিত্র হলে দুধ যেমন নষ্ট হয়ে যায় ঠিক তেমনটাই। মানুষ পরিপক্ক হলেই তার বিয়ে করেত হয়। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। সবাই সংসার করে। তবে কথা হল, প্রকৃত পক্ষে সবাই কী সংসার করে? বিবাহ বন্ধনের সময় সকল শর্তগুলোই মেনে বিয়ে করে থাকে। সংসারের সকল সুবিধা ভোগ করে থাকে। কিন্তু যে সম্পর্কের জন্য সংসার বাঁধা হয়, আজকাল সেই সম্পর্কটাই তো বিলীন হওয়ার পথে। তবে কেন এ আনুষ্ঠানিকতা। লেখক চোখ বন্ধ করে এসব বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে লাগল।

ওদের মাঝে নীরবতা চলে এলো। স্বপন ঘুমিয়ে পড়েছে। লেখকের ঘুম ঘুম ভাব চলে এলেও সে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির পাশে একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরটি নানান ফলজ গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত। ওদিকটা লেখকের মনোযোগকে আকর্ষণ করল। লেখক এ ঘর পার হয়ে ও ঘরের অর্থাৎ বাহির বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই মিলির দেখা মিলল। কাঠের বেঞ্চির উপর গা এলিয়ে বসে গল্পের বই পড়ছে। হাতের ইশারায় লেখক কে ডেকে নিল। এমন সময় হঠাৎ করেই আবার মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
লেখক- “মেয়ে আর প্রকৃতির পাশাপাশি বসবাস। এ দুটোর কান্না একবার শুরু হলে থামতেই চায় না।”
পৃষ্ঠা- ০৬

 

মিলি- “এটা কিন্তু বেশি হল।”
লেখক যা বলেছেন এর বেশি এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই আর কিছু না বলে মুচকি হেসে উড়িয়ে দিলেন।
ক্ষণকাল পরে মিলি জিজ্ঞেস করে- “বৃষ্টি প্রকৃতিকে উদাসীন করে।”
লেখক- “বটে। সাথে ঘুমের জন্যও বেশ উপযোগী।”
মিলি- “সবই বুঝেন তবে কেন সব উড়িয়ে দিচ্ছেন।”
লেখক- “আগুনের বর্ণ সুন্দর। এর উপকারিতা বলে শেষ করা শক্ত। কিন্তু যে ছোঁবে সে পুড়ে ভস্ম হবে। সব কিছু নিয়ে খেলা চলে না। বাজি চলে না।”
মিলি- “আমি ওটার স্বাদ নিতে চাই.

অনুমানে নাহি নেব স্বাদ,

পুড়বো বলে পণ করেছি          তবেই হোক মোর সঠিক জাত।

ফেরাওনা হেরি-       যেন কারণ দর্শনে,

বৃক্ষ মালা স্বাক্ষী মোর অনুবৃত্তে।’’

লেখক আরও স্পষ্ট হলেন যে, হেনেস্তা করার নিমিত্তে মিলি নেমে পড়েছে। ওর, লিখনী সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে। আরও পাকাপোক্ত হতে চাচ্ছে, যেন জানা বিষয়গুলোর প্রতি আরও বিশ্বস্ততা বাড়ে। এখন সাবধান হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই । মিলি তার গল্পের বই থেকে একটা কাগজ বের করে লেখকের দিকে এগিয়ে দিল। কাগজে লেখা ছিল একটি কবিতা- এমন-

ঋষি

আমার মনের কথা বলতে পারি না,

সে কথাটা বাইরে আসতে চায়।

কে যেন হেথা– সর্ব শক্তি দিয়ে টেনে ধরে;

দাপড়ে দাপড়ে মরে সে কথা;

কেন সে দিল না ছাড়ি- মন তা আজ জানতে চায়।

পৃষ্ঠা- ০৭

 

খাঁচার শক্ত দেয়ালে আটকে!

হায়! সে কথা–

জীবন কে অতিষ্ঠ করে তুললো,

মুক্তির জন্য ব্যাকুল করল,

তবুও সে স্থান ছাড়ল না!–

কেন এমন হয়? মন আজ জানতে চায়!

বুঝি–

সহজ সে কথা– ভালোবাসি।

সমর্পণের সে কথা– ভালোবাসি।

মায়া ভরা সে কথা– ভালোবাসি।

অধিকার আদায়ের কথা– ভালোবাসি।

মুক্তির সে কথা– ভালোবাসি।

তবুও সে, ছাড়ল না সে কথা।

মন আজ জানতে চায়- ‘সে, কত বড় ঋষি?’

লেখক একমত বীতশ্রদ্ধ হয়েই নীরব রাগে কাগজটি জব্দ করে অপর প্রান্তে গজ গজ করে একটি কবিতা লিখে দিল। সেই সাথে কাগজটির ঠিক উপরে ডান পাশে লিখে দেয়- ‘কবিতাটি মিলি-কে উৎসর্গ করিলাম।’ দেবার সময় মিলিকে বললেন-“মন স্থির হলে পড়ে নিও। অশান্ত হৃদয়ে অনুভূতিগুলোও অশান্ত হয়।”
মিলি- “আমি বাড়ি থেকেই স্থির করে এসেছি। অনুমতি পেলে এখনই পড়তে চাই।”
লেখক চুপটি করে রইল। অব্যক্ত এক আশ্বাসে মিলি কাগজটি খুলে দেখে। তাতে লেখা ছিল-

ইনসুরেন্স

উপলব্ধি

সত্যিই কি ভালোবাসাতে মুক্তি,

বিহঙ্গ, জ্যোতির্ময়, প্রাণ শক্তি।

ভালোবাসা, বিষাদ করেছে মন,

এর বেশি জাগে ডাকে মরণ!

ধরে না কেন, বুঝে না সে,

মোর শ্রাবণ লয়ে মুক্তি দিতে পারে।

পৃষ্ঠা- ০৮

 

যুক্তি

ভালোবাসায় বিরাট অনুভূতি,

দিতে পারে বেঁধে এ আকুতি।

লড়াকু ষাড়ের ওই ধারালো শিংয়ে,

অথবা শান্তিময় সাদা পায়রার পায়ে।

চুকে গেল, মিটে গেল, দাওয়াত পৌঁছাল।

পারবে কি সে– মনই যার শক্তি;

সংসার উড়িয়ে দিয়ে চেয়ে মুক্তি?

হেথায় বিরাট নেশা– জানো হে,

দায়িত্ব আরও পরম করে তুলে?

পরিণাম

আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ কি মায়ার সাজে,

নদীর বুকে চিকন ঢেউয়ে ঝিলিমিলি করে।

তাতে ভাসিয়ে দিলাম মোর ভালোবাসার চিঠি,

হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি- আসে মুক্তি।

যত হিমেল বায়ু অথবা হাসনাহেনার ঘ্রাণ,

উদাস করে– এমন কি আর সইতে পারে?

নৌকা দোলে হেলে দোলে; তবুও বৈঠা হাতে বয়।

নির্ভুলে হয় সংসার- তাই সব নিয়ন্ত্রণ হতে হয় সঠিক-এ।

লেখক, ভেবেছিল মিলি বিষয়টা উপলব্ধি পূর্বক ক্ষান্ত দিবে। তার পাগলামির যবনিকা টানবে। কিন্তু বিষয়টাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল– “আজকের আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। মেঘটা অহেতুক হলেও কি আর মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঠবে।”
লেখক খানিকটা শব্দ করে বলে উঠল-
পৃষ্ঠা- ০৯

 

“তুমি কি চাও।’’
মিলি উঠে দাঁড়াল।  লেখক মিলিকে বসতে বলল– “মিলি, তুমি বুদ্ধিমান। বুঝতে চেষ্টা কর।”
মিলি জবাবে বলল- “আমার বড় সাধ ছিল লেখকের প্রেমে পড়ার। আমি আপনার প্রেমে পড়তেই চাই।”
লেখক হেসে উত্তর কাটলেন- “কেন?”
মিলি- “ভয় পেয়েছেন?”
লেখক- “হেয়ালি ছাড়। বল কেন?”
মিলি- “আপনার অনুভূতি চুরি করতে চাই। বলতে পারেন কবি মনের লোকায়িত শক্তি যা তাকে বিকশিত করে তুলে, তা দেখতে চাই।”
লেখক- “এ তো সহজ কাজ। দু’একটা বই আর কিছু যৌক্তিক অনুমান করলেই পাওয়া যাবে। তবে প্রেমের প্রস্তাব কেন?”
মিলি-“হাতের কাছে ল্যাব. থাকতে পুস্তককে কোনো বিশ্বাস করব?”
মিলির ধারণা লেখক মাত্রই প্রেমিক হয়ে থাকেন। আর যদি তাই না হতেন তবে তারা লেখনিতে এত সুন্দর করে কীভাবে উপস্থাপন  করে থাকেন। লেখকরা আবার পাষাণও হয়ে থাকেন। এমন ঘটনার জন্ম দেন যেন পাঠক সমাজ তা পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অন্য দিকে লেখক তা উপভোগ করেন। সাধারণ মানুষ দেখেন ভিন্নতর চোখে। তাদের সাথে নির্জীব বস্তুটিও কথা বলে। মিলি এই আকণ্ঠ অনুভূতির রহস্যগুলো জানতে চায়।

অন্য দিকে লেখক জানে, প্রেম নিয়ে খেলা বা বাজি চলে না। এটা এমন এক অনুভূতির জন্ম দেয় যা, মানুষকে ফতুর করে তুলে। এই ভিখারী দশা থেকে মৃত্যুই একমাত্র মুক্তি দিতে পারে। তবে অনেকেই মনে করে মৃত্যুতেও এর বিনাশ নেই। ইহকালের অপূর্ণতা পরকালে গিয়ে পূর্ণতা পাবে। মন একবার হারিয়ে গেলে তা আর কখনোই খাঁচাতে ফিরে আসে না। লেখক মিলিকে তাই বারেবার বুঝাতে চেষ্টা করল।

অনেকেই মনে করেন ভালোবাসার অপূর্ণতা ইহকালের পূর্ণতা না পেলেও পরকালে পূর্ণতা পাবে। আসলে এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তাছাড়া মন একবার হারিয়ে গেলে তা আর কখনও খাঁচায় ফিরে আসে না। লেখক আবারও মিলি কে এ কথাটাই বুঝাতে চেষ্টা করলেন।
লেখক- “প্রেম নিয়ে জেদ চলে না। মন কেবল দোল খেলে আমৃত্যু দোলায়।”
মিলি- “তবুও পড়ব। আমি প্রেমে পড়তে চাই। আমি জানতে চাই।”
লেখক হেসে বলল– “যদি কখনো সত্যিই তোমার প্রেমে পড়ে যাই– তখন? আর মনকে ফিরে আনতে পারা গেল না।”
মিলি- “সে তো সহজ.?”
লেখক আবার প্রশ্ন করল- “সত্যিই কী সহজ?”
পৃষ্ঠা- ১০

 

টিনের চালে পড়া বৃষ্টির ধারা মিলি তার হাতের উপরে ফেলে এক রকম অদ্ভুত আওয়াজ সৃষ্টি করছে যা সত্যিই আনন্দের। সেই সাথে পানির কণাগুলো ছিটে পড়ছে অন্যত্র। মিলি কিছু বলতে উদ্যত হলে লেখক মিলি কে থামিয়ে দিয়ে বলল-“বৃষ্টির এই শীতল পানির তুমি কি মায়ার অনুভূতি নিতে চাও?”
বৃষ্টির পানি হাতে নিয়ে মিলি বলল- “এই তো নিচ্ছি।”
লেখক- “এভাবে সাধারণের অনুভূতি পেয়েছো, কিন্তু লেখকদের মতো করে পেয়েছো কি?”
মিলির কৌতূহলী চোখ আনন্দে ভরে উঠল। মিলে লেখককে অনুরোধ করতে লাগল। লেখক তাতে রাজি হয়ে বলল-
“হাত প্রশস্ত করে হাতের তালুতে আবার বৃষ্টির ধারা ফেল। পানির দুই-একটা ছিটে ফোঁটা তোমার গায়ে এসেও যেন পড়ে।”
মিলি ঠিক তাই করল।-“তারপর।”
লেখক- “এবার চোখ বন্ধ করে বিরাট দম নাও। দম চেপে ধরে রেখে হালকা করে ছাড়বে।”
মিলি- “তারপর।”
লেখক- “তোমার সমস্ত ইন্দ্রীয় সজাগ করে রেখে মনোযোগটা রাখবে রাখবে হাতের ওই তালুর উপর।”
মিলি- “হুম।”
লেখক-“মনোযোগ আরও বৃদ্ধি করো। এবার ভাবতে থাকো। কোন কিছু পেয়েছো কি না?”
মিলি- “না।”
লেখক গাঢ় ভাবে মিলিকে আবার বলল- “মিলি, কিছু কী ঠাহর করে উঠতে পেরেছো? তোমার সমস্ত অঙ্গ শীতল হয়ে এক রকম স্নীগ্ধ অনুভূতি জুড়ে দিয়ে মাতাল করে তুলছে কী? গায়ের শিড়দাঁড়াগুলো শীতে টনটন করে উঠছে কী?”
মিলি হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকানোর মত উঠে পেছনে থাকা বেঞ্চির উপর ধপাস করে বসে পড়ল। মিলি দেখতে পেল, তার গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গিয়েছে। গায়ে থাকা ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে আবার গায়ে জড়ালো।

লেখক জানতো, এমন একটা প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। তবে প্রতিক্রিয়ার মাত্রাটা এত বড় হবে সে তা ভাবতে পারেনি। মিলির দিকে আর ফিরে তাকাতে পারলেন না। মিলি জড়সড় হয়ে বসে রইল। শুধু লেখকের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। কোন কথা বলল না- আর। লেখক, বৃষ্টিতে নেমে পড়ল। বৃষ্টির টিপটিপ আওয়াজ, গাছের ভেজা পাতার স্পর্শ, পুকুর পাড়ে থাকা নারিকেল গাছের শব্দ। এরপর সে কাঁঠাল গাছের তলে এসে দাঁড়াল। অবশেষে আধ ঘন্টা পার করে আবার ফিরে এলো।
মিলি সহজেই বুঝতে পেরেছে যে, লেখকগণ যে উচ্চতায় বিচরণ করেন, সাধারণ মানুষের পক্ষ্য তা ছোঁয়া বা উপলব্ধি করা অত্যন্ত দুর্বোধ্য। লেখকগণ তাদের লেখাতে যে সকল অনুভূতি বা বিচরণগুলো সর্ব সাধারণের বোধগম্য করার জন্য অতি সাধারণ ভাবে তাদের যুক্তি, কর্ম উপস্থাপন করে থাকেন। মিলি যে বৃষ্টির পানির অনুভূতি/উপলব্ধি সহ্য করতে পেল না অথচ লেখক সেই অনুভূতিই উপলব্ধি পূর্বক বৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় ভিজে গ্রামীণ পরিবেশের স্বাদ আচ্ছাদন করে নিল।

দুপুর হয়ে এসেছে। বাহিরে হালকা রোদ। স্বপন পুকুরে গোসল করতে গিয়েছে। আর লেখক বিছানার পা এলিয়ে রেখে খাঁটের ছাউনির সাথে মাথা হেলান দিয়ে একাদশ শ্রেণীর বাংলা বইটি মনোযোগ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল। তার মনোযোগ মূলত গল্প-কবিতার শ্রুতিমধুরতা, বিরাম চিহ্নের ব্যবহার, কিছু শব্দার্থ ইত্যাদি খেয়াল করছেন। এমন সময় মিলি নীল রঙের জর্জেট জামা পড়ে স্বভাব সুলভে হাস্যোজ্জ্বল রূপে প্রবেশ করল। এবং বলল- “শুভ দুপুর।”
লেখক- “এসো। বসো। শুভ দুপুর।”

মিলি তার হাতের মুষ্টি থেকে একটি কবিতা বের করে নিল। পড়ার টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে উপর বসে আবৃত্তি শুরু করে দিবে, ঠিক এমন সময় স্বপন রুমে প্রবেশ করল। স্বপন দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে শ্রোতার বেশে খাটের উপর এসে বসল। মিলি স্বভাব সুলভভাবে মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে হাত উড়িয়ে আবৃত্তি করতে লাগল-

“প্রাণ তব প্রাণ

ধর আমার হাত,

বুঝলে কিছু? পেলে?

মুণ্ডু নাড়াও.

-আচ্ছা বাদ দাও।

লেখক ইতঃস্তত হয়ে টেবিলের উপর কি যেন খুঁজে দেখলো, কিন্তু পেলো না। স্বপন কিছু একটা বুঝে নিল। আর বলল- “তারপর।”

চোখে রাখ চোখ

-কি? পেলে কিছু? বুঝলে?

-কালো, গোল, তার পাশে সাদা।

ও বুঝেছি আর কিছু দেখনি?

-ঠিক আছে।

 

দেখ মোর ওষ্ঠ,

কম্পন করে? বুঝ হে?

কথা বলছি বলে দাপড়ায়,

তাই নাহি বুঝ অনুমানে।

-থাক তবে।

পৃষ্ঠা- ১১

 

 আমার বুকে রাখ তোমার কান,

-কি বুঝলে? কান্নার আওয়াজ পাও?

নাকি হৃদপিণ্ডে টিপটিপ আওয়াজ বিনে

-সবই উধাও।

প্রাণ বুঝলে না প্রাণের কথা,

ঠিক আছে– তবে থাক।”

স্বপন হাতে তালি দিয়ে উঠে উচ্ছসিত প্রশংসা করল। অন্যদিকে মিলি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
মিলি- “কবিতা আবৃত্তি করতে পারি না; তাই বলে একটা ধন্যবাদও তো পেতে পারি।”

লেখক নিজের ভুল বুঝতে পেরে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল ঠিকই কিন্তু তা আর কোনো প্রয়োজনে আসল না। মিলি ক্ষোভটা নিজের মধ্যে কৌশলে ধরে রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে রুম ত্যাগ করল।

দুপুরে খাবারের টেবিলে মিলি এলো না। নোটিশ করেছে ও অসুস্থ; তাই শুয়ে আছে। সে পরে খাবে। অন্যায়কারীর আত্মা প্রায়শ্চিত্তের জন্য সর্বদা জাগ্রত থাকে। কেউ বুঝুক আর নাই বা বুঝুক কিন্তু লেখকের বুঝতে বিন্দু মাত্র অসুবিধা হলো না যে কোন অভিমানের মেঘ জমাট বেঁধেছে। স্বপনের মা লেখককে উদ্দেশ্য করে বললেন-
“বাবা এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? শহরের মানুষ। গ্রামে..”
লেখক, বাকি কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বরং বলল- “না না কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। বরং খুবই উপভোগ করছি। সুযোগ পেলে আবার চলে আসবো।”
স্বপনের বাবা- “বেশ, চলে আসবে। আমরা খুবই বরং খুশিই হব। বুঝলে বাবা আমার জীবনে অনেক বই পড়েছি। কিন্তু সারা জীবন একটা লাইনও লিখতে পারিনি। তবে এ কথা সত্যি যে আমি ভালো চিঠি লিখতে পারতাম। কি বল স্বপনের মা?”
মুখের সামনে আঁচল টেনে লাজ নিয়ে বললেন- “কি যে কোথায় বল! ছি ছি ছি..।”
স্বপনের বাবা আবেগটাকে ধরে রাখতে পারলেন না। অট্টহাসিতে আজকের দুপুরটা সমার্থক হয়ে উঠল।
পৃষ্ঠা- ১২

 

একজন বাদক যে বাঁশি বাজায়, সেই বাঁশির সুরে বাদকের কান্না এলেও বাঁশিটি তাঁর হাতে কাছেই রাখতে চায়। আর এটাই হল- মায়া। দুপুর পেরিয়ে গেলেও মিলিকে দেখা গেল না। বিকালে বেলায় স্বপনের সাথে লেখকের গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটে বেড়ানোর কথা ছিল। লেখক সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল প্রায়, সে ঘুরতে যেতে চায় না। কিন্তু কি যেন ক্ষোভ থেকে তাকে তা করতে দিল না। সরু ও সুন্দর কাঁচা মাটির পথ শেষ প্রান্তে গ্রামীণ বাজার। রাস্তাটি প্রায় দেড় মাইলের দূরত্ব হবে হয়ত। দু’ধারে অবারিত সবুজ মাঠ, মাটির ঘ্রাণ, আকাশে রোদ আর মেঘের ছায়ার খেলা। পায়ে জড়িয়ে গিয়েছে কাঁদা মাটি। এমন মাতোয়ারা পরিবেশে লেখক ডুবে গেল যেন এক সমুদ্রসম গ্রামীণ সতেজ পরিবেশের মাঝে। লেখক তার আপন শস্য(অনুভূতির) সংগ্রহে যেন মাতোয়ারা হয়ে পড়লেন।

 

আকাশে দমকা দমকা কালো কালো মেঘ। সূর্যের ক্ষীণ আলো। ভেজা গাছপালা। ভেজা মাটি। এই বুঝি বৃষ্টি নেমে গেল বলে এমন ভীতি। বিস্তীর্ণ খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে কাঁচা রাস্তা পার হওয়ার সময় লেখক স্বপনকে থামিয়ে দিল। লেখক রাস্তার কিনারায় থাকা দুর্বা ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে নির্মল বায়ুতে ফুসফুস ভরে তুলল। ভিতরের দূষিত বায়ু বার করে বিশুদ্ধ বায়ুতে পূর্ণ করে নিল সে। এ প্রশান্তিটুকু বরং তার মনকে নির্মল তৃপ্তি এনে দিল।

দূর থেকে ঠাহর করা যাচ্ছে বাজার সন্নিকটেই। একটা ভারি আওয়াজ বাতাসে ভাসে আসছে। বাজার হল গ্রামের লোকদের মিলন মেলার পাশাপাশি পুরো সপ্তাহের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র যোগান বা চাহিদা মিটাবার স্থান। শহরের বাজারগুলোর মত চাকাচিক্য না থাকলেও লোকের উপস্থিতি প্রায় সমান। বেশির ভাগ লোকজনের কোমরে লুঙ্গি গুজানো এবং একেবারে পুরানো জামা গায়ে জড়ানো। কিছু ব্যক্তির কাঁধে আর কিছু ব্যক্তি কোমরে গামছা বাঁধা। গুটি কয়েক জনের পায়ে প্লাস্টিকের জুতা থাকলেও কাঁদায় এমন বেহাল দশা। এরা সবাই ব্যাগ অথবা ডালা নিয়ে অল্প পরিমাণ করে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ক্রয় করছে। খাদ্য দ্রব্যের অধিকাংশই তাদের স্থানীয় মাঠে জন্মানো এবং সতেজ।

 

স্বপন বেশ সংকোচবোধ করলেও সে লেখককে আমন্ত্রণ জানাল পাউরুটি আর মিষ্টির শিরা দিয়ে ভিজিয়ে থেতে। লেখক উৎসাহ ভরে আমন্ত্রণ গ্রহণ করল। লেখক বুঝতে পেল, মিষ্টিগুলো শহরের মত এতটা নরম নয় কিন্তু মিষ্টি পাউরুটি সংমিশ্রণের স্বাদটা চমৎকার। কিছুটা আনমনে হয়ে লেখক স্বপনকে বলল- “নবনিতা আর মেয়েটা কে যদি আনতে পারতাম।”

(নবনিতা লেখকের স্ত্রী’র নাম।)

স্বপন- “হু! আনন্দ পেতো ওরা।”

বাজার-সদাই ছিল অল্প পরিমাণ কিন্তু দুই বন্ধু মিলে পুরো বাজার ঘুরে ঘুরে দেখল। পান-সুপারি, মাছ, তরিতরকারী, ধান-পাট, মুরগীসহ আরও কত কি যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজারে উঠেছে। স্বপন বাজার থেকে যা যা কিনেছে তার তিনগুণ দাম দিলেও শহরে সেই পরিমাণ পণ্য পাওয়া যাবে না। ছোট দেশী মাছগুলো তখনও ঝাঁকির ঢাকনার উপর লাফাচ্ছে। এটা দেখে লেখকের ইচ্ছে হলো পুরোটাই কিনে নিতে, যেটা শহরে ঘটে। কিন্তু লেখক পরক্ষণেই ভাবল- সব কিছু ভাগাভাগি করে নিয়ে চলাটাই/নিয়মটাই হল গ্রামের নিয়ম/সম্প্রীতি।

 

বাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। হাত-পায়ের যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা যদি নবনিতা দেখতে পেতো, তবে এ ভরসন্ধ্যে বেলায়ই গোসল বিনে মুক্তি ছিলো না। এখানে নবনিতা নেই; কাজেই দিব্যি হাত-মুখ ধুয়ে শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন।

পৃষ্ঠা- ১৩ 

 

লেখক ক্লান্ত শরীরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে  রইল। দু’চোখ বুজে রেখে সেই ফেলে আসা সময়গুলোকে নিয়ে ভাবছে। এমন সময় কৃত্রিম শব্দ করে মিলি রুমে ঢুকে পড়ল। কিছু বলতে না বলতেই পাশে থাকা চেয়ারে এসে বসল। লেখক মিলির দিকে তাকালো বটে কিন্তু কোনো কথা বলল না আর। সে চোখ বন্ধ করে আবার আপন ঢঙে বসে রইল আর ভাবতে থাকল। এমন সময় মিলি একটি কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দিল-

সমর্পণ

“অনুভূতি গোপনই থাক,

চাওয়াটা সামনে আসুক।

অনুভূতি হল শক্তি আর-

চাওয়াটা আন্দোলনের মুখ।”

লেখক চোখ খুলে সোজা করে বসে কিছুটা বিষণ্ন হয়ে বলল- “মিলি, লেখক অনুসন্ধানে নামো না। শেষ অবধি সইতে পারবে না। করুণ পরিণতি ডেকে আনবে।”

 

মিলির সাবলীল উত্তর- “আমি সুপ্ত খনির অনুসন্ধানেই নেমেছি। না হয় হলাম সন্ন্যাসী।

কিযে খুঁজে বেড়াই- জানি নে,

কি যে আঁকি, বুঝি নে।

চাওয়াটা প্রখরতর-

এর শেষ কোথায়, খোঁজে পাইনে।

সত্যি বলতে কি জানেন- লেখকরা হয়ত আয়না। কেউ সামনে এসে দাঁড়ালে তার মনের ভেতরকার সব দেখতে পায়।

উড়ে দিতে ইচ্ছে জাগে-

শূন্য হয়ে থাকতে।

কখনও ইচ্ছে জাগে-

পাখির পায়ে, ভ্রমরের গলে,

ওই আকাশে সাদা মেঘের ভেলায়,

অথবা অগ্রাণ বায়ুর অগ্রে।

 

“আমি যদি পারতাম তবে উড়িয়ে দিতাম…”

লেখক বললে- “সত্যিই পারতে?”

মিলি- “আগে বললে হয়ত পারতাম না; তবে এখন, মন বলছে পারব।

পৃষ্ঠা- ১৪ (অসমাপ্ত)

 

🌼👉চলবে……………………..

উপন্যাসঃ লেখক
তারিকুজ্জামান তনয়
জুন’২০১৯

 

 

বুনোপুষ্প

 

 

 

 

 

 

“মন সবসময় ক্ষুধার্ত থাকে। যা চায় তা সে পেলেও, তৃপ্তি কি মেলে…!”

 

 

 

 

 

 

সহিত্য সুখী করে

 

 

 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments