মৌমাছি

⇒১

আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো জানালার ফাঁক দিয়ে আসা প্রভাতের কোমল আলোরঝলকে। ঘুম ভাল হয়েছে। তাই মনের ভেতর বেশ আনন্দ আমেজ বিরাজ করছে। আমি উঠে গিয়ে জানালার দুই কপাট ‍দুই দিকে খুলে দিলাম। তখন আলোগুলো শিশুটির মতো আলতো বেগে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। এতে করে আলোর দ্যুতি ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো। আবার সরে এসে আমি বিছানার উপর শুয়ে রইলাম। বাহিরে হালকা বাতাস বইছে। মাঝে মধ্যেই লিচু গাছের পাতাগুলো যেন আলোর সাথে আড়ি দিয়ে খেলা করছে। এ সময় সূর্যের কোমল আলোর স্পষ্ট রেখা তির্যক ভাবে জানালায় এসে পড়েছে। এ যেন এক অপূর্ব আলো-ছায়ার মিলন মেলা।

এরই মাঝে কয়েকটা টা মাছি এসে হাজির। ভনভন শব্দে দারুণ ব্যস্ততা প্রকাশ করছে। কখনো নাকের উপর, চোখের উপর, কানের, কপালের উপর; গায়ের উপর বিচ্ছিরিভাবে বসছে। বিরক্তিকর! এ আপদ আসার আর সময় পেলো না।

আমি তখনো মাছির সাথে কৌশলী যুদ্ধ করে চলছি। এমন সময় একটা রঙিন মাছি উড়ে জানালার গ্রিলে এসে বসলো। আরও দুই-তিনটে এলো। এরপর আরও কিছু রঙিন মাছি জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কেন যেন চিৎকার করতে ইচ্ছে করলো না। দেখি না কি হয়। তবে ভয় যে পাইনি তা নয়। আমার বাবার কাছে শুনেছি, মাছি কামড়ালে তার  বিষের যন্ত্রণায় মানুষ মারা যায়। তবে শুনেছি, মাছিদের মধ্যে ভিমরুলের (এক প্রকার মাছি) কামড় খুবই যন্ত্রণাদায়ক। এমন কথাও শুনেছি, ভিমরুলের রাগ হলে সত্তর হাত পানি নিচে গিয়ে হলেও কামড়িয়ে আসে। 

তবে আমার মনের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হলো, আমি তো আর ওদের কোন ক্ষতি করি নি। তাই আমাকে ওরা কামড়াবে না। 

আমি আসলে চিনি না কোন মাছিগুলো মধু দিয়ে থাকে। তবে হ্যাঁ! আমি মাছ মেরেছি বল্লার টুপ (মাছির ডিম) দিয়ে। সে বাসাগুলোতে কখনো মধু দেখিনি। বল্লার টুপ হলে কই মাছ, শিং মাছ পাগল হয়ে বড়শিতে ধরা পড়ে। এই তো কিছুদিন আগের কথা। থাক ওসব বিষয়। তবে একটা কথা মনে পড়লে আজও মনের মাঝে খুবই পীড়া দেয়। একদিন ওদের বাসা থেকে মাছি তাড়িয়ে দিয়ে বল্লার টুপ সংগ্রহ করে দুই পা যেই না পিছিয়ে এসেছি; আর অমনি গায়ে থাকা গেঞ্জির ভেতরে উড়ে এসে ঢুকে পড়ল। আর কামড় বসিয়ে দিলো। আমি তো সব ফেলে চিৎকার করে দৌড়ে দিয়ে বাঁচি! গেঞ্জিটা দ্রুত খুলে ফেলাতে না ফেলতেই ছয়-সাতটা কামড় বসিয়ে দেয়। মাছিগুলোকে মারতেও পারিনি। গেঞ্জি খুলে ফেলতেই উড়ে চলে গেলো। এরপর তাড়িঘড়ি করে চুন (পান-পাতাতে খাওয়া চুন) এনে লাগিয়ে দেই।

কিছুক্ষণ আগে জানালাতে যে আলো ছিল তা এখন আর নেই। সূর্য সরে গিয়েছে। তাই জানালাতে এখন ছায়া নেমে এসেছে। বরং বাহিরের আলো বাহিরের দিকে ক্রমেই  ছড়িয়ে পড়ছে। রোদ টা ওদিকটায় একটু একটু করে পালিয়ে যাচ্ছে লজ্জাবতী বধূটির মতো। এমন সময় সাতভায়লা পাখির দল লিচু গাছের তলে শুকনো পাতার আড়াল থেকে খাবার খুঁজতে নেমেছে। সেই সাথে তাদের কিচ্ কিচ্, কিক কিক শব্দে পরিবেশটা ভারি করে তুলেছে। আচ্ছা, পৃথিবীতে কী এটাই নিয়ম- শান্তিগুলো অশান্তির ঠেলায় মরে যায়? আনন্দ স্থায়ী হয় না! মূলত নানা অসঙ্গতির মাঝেই কি শান্তি খুঁজে নিতে হয়?

আমি দেখলাম রঙিন মাছিগুলো পশ্চিম-উত্তর কোণা থাকা রুয়া (কাঠের পাশির) সাথে ঝুলন্ত পুরানো ক্যালেন্ডারের পেছরে গিয়ে বসেছে। এর কিছুক্ষণ পর আরও কিছু মাছি এসে যুক্ত হলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সব মাছি গুলো ওই একই জায়গায় জমতে লাগলো। মাঝে মধ্যে দুই একটা মাছি সেখান থেকে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসছে। আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল, কিন্তু চোখ বন্ধ রাখতে ইচ্ছে হলো না। তাই টেবিলের উপর থেকে একটা বই নিয়ে উল্টাতে লাগলাম।

আমরা যদি সাহিত্য সমস্ত কর্মকে দুই ভাগে ভাগ করে দেখি- এক অংশ বেদনার, আরেক অংশ আনন্দের। তবে বেদনার অংশ বেশি বলেই মনে হয়। কিন্তু, তা কেন? তাহলে কী যারা সাহিত্য রচনা করেন, তাদের দুঃখ বোধ বেশি? এমন কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘোরপাক খেলে গেলো।

⇒২

সাহিত্য হলো কল্পনা। কল্পনাকে বাস্তবতার সাথে মিল করে দেওয়া। মানুষের ভেতরকার অনুভূতিকে তাজা করে তোলা। বিবেক বুদ্ধিকে সচল করা। একটা বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চিন্তা করতে শেখা। এমন সময় মা আমাকে ডেকে নিলেন। সকাল বেলা, তাই ঘর থেকে বের হতে একটু দেরি হয়ে গেলো। মা বললেন, বাজার থেকে রান্না করার জন্য সয়াবিন তেল আনতে। 

আমাদের বাড়ির উঠান বেশ ছোট। তবুও এই অল্প জায়গাতে ম্যানেজ করে সার্কেলের মধ্যে ক্রিকেট খেলা যায়। এই প্রভাতেই কয়েকজন ছেলে মিলে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছে। উঠানের মাঝ দিয়ে চলা-ফেরার সময় সুযোগ করে নিয়ে চলতে হয়। ওদের খেলাটা বেশ জমে উঠেছে। পরস্পরের প্রতি চিল্লাপাল্লা, রাগারাগি তো আছেই। কখনো রান নিয়ে, কখনো মৌখিক নিয়মকানুন নিয়ে, আবার কখনো শর্তের চেয়ে বেশি জোরে বল ছোঁড়ে ইত্যাদি। মাঝে মধ্যেই ওদের এমন খেলা চলে; তাই ওদের প্রতি বাড়ির কারোর-ই তেমন কোন অভিযোগ নেই।

আমি জামা পরিবর্তন করার জন্য আবার ঘরে গিয়ে দেখি, মৌমাছিতে ঘর ভরে গেছে। এতে করে ভয় পেয়ে গেলাম, তবুও কাউকে কিছুই বলা হয় নি। ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট খেলা দেখে আবার ঘরের ভেতরে লক্ষ্য করি; মৌমাছিগুলো সরে গিয়েছে। ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখি, ক্যালেন্ডারে ছেয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে জামা নিয়ে দ্রুতই বের হয়ে এলাম।

এমন সময় আমাদের পাড়ার একজন কাকা এলেন। কাকা, দেখতে বেশ কালো। শুকনা। মেজাজ তার চড়া। ছেলেদের সাথে তেমন কোনো খাতির নেই তার। এই সাতসকালে ছেলেদেরকে ক্রিকেট খেলা খেলতে দেখে খোঁচা দিয়ে কয়েকটা লম্বা কথা শুনিয়ে দিলেন। সময় নেই, অসময় নেই, খেলতে পারলেই বাঁচে। পেটের ভাত কি ক্রিকেট খেলায় দিতে পারবো।- এমন কথাগুলো ছিল তার। 

যা হোক, আমি আমার কাজের জন্য বাজারে চলে এলাম। কাকার কথাবার্তাগুলো যে ছেলেদের ভালো লাগেনি তা ওদের মাঝে কাট্টামো (ঝগড়াঝাটি) স্পষ্ট হয়ে উঠলো। 

আমাদের বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব পনেরো মিনিটের। পথের মাঝে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো। ওর সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। বিশেষ কোনো কথা ছিল না। তাই সময় বেশি নেই নি। সব মিলে বাড়িতে ফিরে আসতে চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগলো।

আমাদের বাড়ির দিকে দুই জন মহিলাকে দৌড়ে আসতে দেখলাম। আমি তখন বাড়ির কাছেই। জোরকদমে বাড়ির দিকে আসতেই দেখি কাকার মুখ ফুলে গিয়েছে। মানে এমন ভাবে ফুলে গিয়েছে যে, তার চোখ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ব্যথায় চিৎকার করছেন। আমি দৌড়ে কাছে গিয়ে বিস্মিত হয়ে গেলাম। কাকাকে ধরতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। আমি তাকে দ্রুতই হাতের উপর উঠিয়ে নিয়ে চেঁচামেচি করতে লাগলাম। বাড়ির ভেতরে থাকা ছেলেদের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। ওরা কেউ এগিয়ে এলো না। মা দৌড়ে এলেন। বাড়ির ভেতরে তেমন আর বড় কেউ ছিল না। আমাদের চিৎকারে রাস্তা থেকে আরও একজন দৌড়ে এলেন। কাকাকে ধরাধরি করে রাস্তার উপরে নিয়ে যেতে না যেতেই ভাগ্যক্রমে একটা ভেন পেয়ে গেলাম। বাজারে থাকা গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে  অতি দ্রুত  নিয়ে যাই। তিনি মুখের উপর হাতের পানির ঝাপটা দিলেন। কাকার জ্ঞান ফিরে এল। ডাক্তার পেইন কিলার ইনজেকশন রেড়ি করতে করতেই ব্যথায় কাঁদতে লাগলেন এবং বমি করে ফেললেন। কাকার অবস্থা দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। শুনেছিলাম, মাছির কামড়ে/ব্যথায় অনেক সময় মানুষ মারা যায়। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে যদি সত্যিই এমন কিছু হয়ে যায়! আমি সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে নিতিই ডাক্তার ইনজেকশন নিয়ে এলেন। যখন ইনজেকশন পুশ করবেন এমন সময় কাকা আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। এবার ডাক্তার নিজেও ভয় পেয়ে গেলেন। কানের কাছে নানান শব্দ করা হলো, কাকার নাম ধরে ডাকা হলো। মুখে আবার পানির ঝাপটা দেওয়া হলো। অবশেষে জ্ঞান ফিরে এলো।

ডাক্তার, কাকাকে চেয়ারের উপর বসাতে বললেন। আবার বেঞ্চিতে সুইয়ে দিলেন। কাকা বমি করার কথা বলছিলেন; কিন্তু বমি করছেন না। আরও কিছু সময় পার হলো। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ডাক্তার সাহেব কাকাকে ইনজেকশন দিয়ে দিলেন। আমি কাকাকে আমার কোলের উপর তার মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুতে বললাম। প্রকৃতপক্ষে তার হাত-পা-মুখ এমন ভাবে ফুলে গিয়েছে যে তার নাক-কান-গাল-চোখ পুরোটাই একটা বলের মতো দেখাচ্ছে। কাকা, তার হাত পা চুলকাতে লাগলেন। অন্যদিকে তার চোখ দিয়ে জল বেরুচ্ছিল। এমন পরিস্থিতি দেখে আমার অত্যন্ত খারাপ লাগতে লাগলো।

⇒৩

আমরা এতদ সকল কাজ হতে না হতেই দেখি আমার মা বাজার পর্যন্ত চলে এসেছেন। ডাক্তার সাহেব মায়ের কাছে এসবের পেছনের ঘটনা জানতে চাইলেন।

ছেলেরা উঠানে ক্রিকেট খেলছিল। ওরাই মিলে উঠানের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে চেঁচামেচি করছিল। এ সময় ভাইজান বাড়ির মধ্যে আসেন। এই সাতসকালে সকালে পড়ালেখা বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলছিল বলে ছেলেদেরকে কথা শুনাচ্ছিলেন । ভাইজানের কথায় কোন কর্ণপাত না করে ওরা খেলছিল। এক পর্যায়ে বড় ছেলেটা সজোরে বল বাড়ি দেয়। বলটা ড্রপ খেয়ে ওর (আমার) ঘরের ভেতরে গিয়ে বল্লার (মৌ মাছির) বাসায় গিয়ে পড়ে। সেখানে যে বল্লার বাসা আছে, আমরা কেউ ই জানতাম না। বল লেগে বল্লাগুলো ঝাঁক ধরে উড়তে শুরু করে। ভনভন করে শব্দ করতে থাকে। হঠাৎ করেই সবগুলো বল্লা একসাথে এসে উঠানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইজানকে কামড়ে ধরে। এমনভাবে ধরে যে, মাছি বিনা আর কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। ভাইজান কামড় খেয়ে মাটিতে লুটে পড়েন। কেউ-ই কাছে যেতে পারছিলাম না। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবগুলো বল্লা উড়ে চলে যায়। এ দৃশ্য দেখে ছেলেরা ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আমি একাই চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকি। কামড়ের (বিষের) যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে পাগলের মতো বাড়ির বাহির দিকে ছুটে আসেন। তখন আমার এই ছেলেটা চলে আসে; সাথে আরও কয়েকজন। ও, সময় মতো না আসতে পারলে একটা অঘটন ঘটে যেতো।’

মায়ের মুখে এসব শুনে আমার আরও খারাপ লাগলো। সে সময় টায় আমার এতো বেশি কৌতুহলী হওয়া উচিৎ হয়নি। নিশ্চুপ থাকাটা উচিত হয়নি। মাছিগুলো জানালা দিয়ে ঘরে আসার সময় যদি আমি বাধা দিতাম বা কাউকে জানাতাম; তাহলে হয়ত এখন এমন পরিস্থিতি দেখতে হতো না। কাকার এমন দুর্দশার জন্য আমিই দায়ী। 

প্রকৃতির উপসর্গগুলো অনেক সুন্দর। কিন্তু এই সুন্দরের আড়ালে অনেক অসুন্দর নিহিত থাকে। বেছে বেছে চলা টা খুবই অসুবিধার। তবুও আমাদের হয়ত বেছে বেছে চলার অবকাশ আছে। আমার এই নির্বুদ্ধিতা-ই সময় কে অসময়ে পরিণত করে ফেলেছে।

—**–

মৌমাছি

তারিকুজ্জামান মনয়

২০-১০-২০২৪

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments