স্ত্রী জান্নুর অনুযোগ

স্ত্রী জান্নুর অনুযোগ
তারিকুজ্জামান তনয়
লোকে বলে নিজের স্ত্রীর কাছে সস্তা হতে নেই। এতে করে স্ত্রী পেয়ে বসে। মাঝে মাঝে স্বামীকে অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
কিন্তু সমাজের মাঝে কিছু পুরুষ/স্বামী আছে যারা তাদের স্ত্রীর কাছে সস্তা হতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। এ ধরনের পুরুষ বেশ রসিক হয়ে থাকে। সেই সাথে সুখীও হয়। অবশ্য সুখ নিয়ে ভিন্ন মতামতও আছে। সুখটা ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নতর হয়। সম্পর্কের গাঢ়তা/পরিবেশের উপর অনেকটা নির্ভর করে।
যদিও মনের অবস্থা ভালো; কিন্তু ভ্যাপসা গরমে জীবন একেবারে অতিষ্ঠ অবস্থা হয়ে উঠে। ভালো সস্তির মন তখন বয়স্ক পাতার মতো ঝড়ে পড়ে পড়ে এমন হয়ে ওঠে।
অথবা এমন হলো, মন ভালো নেই। খুব কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। এমন সময় হিমেল হাওয়া সদর থেকে মনের অন্দর মহল পর্যন্ত এক শীতল অনুভূতির ঢেউ দিয়ে গেলো। ফলে তখন তার উত্তাল মনেতে শান্ত-শীতল ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগলো।
জান্নুবির স্বামী তার প্রতি দিনের অফিসিয়াল ডিউটিকে মাটি কাটার সাথে জ্ঞান করে থাকে। মাটি কাটতে গেলে সর্দার যিনি থাকেন তাকে ছাড়া আর কেউ মাথা খাটায় না। বা খাটালেও সর্দারের কাছে কোনো গুরুত্ব পায় না। ঠিক তেমনই লাগে তার অফিসটা। কর্তাব্যক্তি খোদা সুলভ জ্ঞান নিয়ে বসে থাকেন। তার বাইরে আর কেউ যে ভালো কিছু ভাবতেই পারে না কিংবা সাধ্যি নেই। তাঁর কাছে অন্য সকল কর্মী হলো অবুঝ শিশুটি। অথবা নির্বোধ যন্ত্র মাত্র।
দীর্ঘ বারো ঘণ্টা শেষে বাসায় ফেরা। কাজ-কর্মের ফলে শরীরটা যতটা না ক্লান্ত তার চেয়ে ঢের বেশি ক্লান্ত ঘরে থাকা সুন্দরী বধূর কথা ভেবে। কিছুটা বেশি ক্লান্তি প্রকাশ করে যদি একটু বাড়তি অনুরাগ পাওয়া যায়! এজন্য জান্নুর স্বামী তার চোখের আঁড়ালে, মনের আঁড়ালে এক রসিক রস বা অনুভূতি গুলো ফুটন্ত জলের মতো টগবগ করে উদলা হয়ে উঠলো।
কিন্তু জান্নু, স্বামীর এ ভনিতার ফাঁদে জড়ালো না। তার মনের মাঝে বরং ততোধিক ক্ষোভ কাজ করলো। সে সারাদিন বাসায় একা একা থেকে তিক্ত হয়ে উঠেছে। চেয়েছিলো দীর্ঘ সময় পর তার স্বামীর বাসায় ফিরে ছোট্ট বাবুদের মতো নানান জ্বালাতন করুক। তার থেকে বাঁচতে জান্নু এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করবে। নানান অভদ্র ভর্তসনাতে রসে রসে উত্তাল সুখ উছলিয়ে পড়বে। সে আরও চেয়েছিলো দিন শেষে তার স্বামী উচ্ছ্বল আনন্দ ধারার মতো চতচকে তরুণ হয়ে উঠুক। দিনের ক্লান্তি মুছে যাক জোয়ারের জলের মতো ক্ষ্যাপাটে অথবা বাঘের মূর্তি হয়ে। জান্নু ভেবেছিলো, সে তখন হরিণির মতো ঘরময় ছুটে বেড়াবে।
জান্নু ভদ্রঘরের মেয়ে। সে জানত, মন এক উড়ন্ত ঘোড়া। তাই সুখ পাবার আশায় মনের পিছু ছুটতে নেই। তাছাড়া, স্বামীর মন ভেঙে দেওয়া যে পাপ। সে জানে না, তার স্বামী বহিরে কতটা অস্বস্তিতে সময় পার করেছে। এসব নানান কথা ভেবে জান্নুর হৃদয় অনুরাগে পূর্ণ হয়ে উঠলো। জান্নু তার স্বামীকে এক পশলা বৃষ্টির মতো পুলকিত করে তুলার জন্য ছোট্ট একটা কবিতা আউড়ালো। কথাগুলো তার মনেরই কথা:
-‘তোমার পন্থ চেয়ে রয়েছি নিরবে।
তুলে এনে যত্নে রেখেছি লাল গোলাপ;
খসে যায় না যেন একটি পাপড়িও।
ও আকাশ তারে বলে দিও-
ভালোবাসার সবটা রঙ
তার পানে ছড়িয়ে দিয়েছি।
সে যেন গায়ে মেখে নেয়।
[বি.দ্র: ও আকাশ…থেকে….গায়ে মেখে নেয়।… পর্যন্ত লাইনগুলো মক্তা’ডায়েরি থেকে নেয়।]
অন্তরের কথাগুলো সুপ্ত পাপড়ি কলি ছেড়ে হাসি মুখে প্রকাশিত হবার মধুর ক্ষণ কতোই না প্রস্ফটিত চকচকে আনন্দের তা কেবল যার অন্তর কলি ফুটেছে সেই কেবল জানে। জান্নু ঠিক শিশুটির মতো কোমল নির্লিপ্তে স্থানে দাঁড়িয়ে রইলো। তার স্বামী মিষ্ট একটা হাসি দিয়ে বলল- “কি চাই?”
জান্নু প্রত্যুত্তরে বললো- “নাহ! কিছু না।”
এই বলে জান্নু পাশের এক রুমে প্রবেশ করলো। আবার তৎক্ষণাৎ বের হয়ে বারান্দা, রান্না ঘর, ডাইনিং স্পেস এ পায়চারি করতে লাগলো। একে ঠিক পায়চারি বলা চলে না; ছুটোছুটি বললেই ভালো মানাবে।
অতঃপর জান্নুকে উৎসর্গ করে তার স্বামী হৃদয়ের কথাগুলো কবিতার লাইনে প্রকাশ করলো:
-ঐ সুদূর থেকে কম্পিত আওয়াজ
বেজে উঠলো হৃদয়ে।
তায় যেন কপাট খুলে গেলো হৃদয়ের
বন্ধ দ্বার ছিঁড়ে ছিঁড়ে।
কিছু ভাষা হতে চায় কথা,
কিছু সুর উঠুক সুর হয়ে।
অবলা মৃতপ্রায় আলো গুলো
তরুণ ও তীক্ষ্ণ হতে চায়
ঠিক বাঁধন ছাড়া হয়ে- আরও
রঙিন হতে।
সে চায় পদ্ম ফুটুক;
আমিও তাই চাই- ‘ তবে তা হোক নিরবে।’
ভ্রমর, পাপড়িকে সুখী কারে ছোঁয়া দিয়ে;
আর অন্তর উদ্বেল হয়-
আঁধারে নিমজ্জিত জোছনার নীরব আলোতে।
ছলছল কলকল নদীর জল বয়ে যায়,
দেখলো তা সকলে।
যুগান্তরের পথে তপসীর কলরব রয়-
হৃদয় ঘরে গোপনে।
তখন জান্নুর মুখে বিকশিত অথচ শান্ত হাসির রেখা স্পষ্ট হয়ে প্রায় ভেসে উঠেছে। ও পাশ ফিরে তীরের ফলার মতো তাক করে তীর্যক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে বলল
-গোল দেয়াতে পাকা ওস্তাদ! আমি তাতে ভিজি না।
-বাগানেতে যে ফুল ফুটেইছে, তা তো ফুটেই আছে। তার গায়ে প্রভাতের আলো অথবা এক পশলা বৃষ্টি ছোঁয়া লেগে হোক না আরেকটু লাবণ্যময়ী।
-আমি মানি না।
জান্নুর চলে যাওয়া থামিয়ে নিকটে বসালো। জান্নু তাতে বাধা না দিয়ে অবলা সাড়া দিলো। এবং তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো
-নিকুঞ্জ থেকে আহরিত পুষ্প
কেউ অঞ্জলি দেয় ডালায় ডালায়;
আবার কেহ অঞ্জলির পুষ্প ঢালে
অন্তরে অন্তরে
অন্তরযামীর নিরুপমায়।
কথার মধু সত্যিই পৃথিবীর সকল তরলের চেয়ে উৎকৃষ্ট পানীয়। যা মানুষের দূর্বোদ্ধ হৃদয়ের শক্ত পাথরকে মুহূর্তেই গলিয়ে পানি করে ফেলতে পারে। শুধুই কি তাই, তার থেকে সুগন্ধি পর্যন্ত ছড়াতে পারে।
অতঃপর স্ত্রী জান্নু পরাজয় মেনে নিয়ে মানব ধর্মে মনোনিবেশ করলো।
স্ত্রী জান্নুর অনুযোগ
তারিকুজ্জামান তনয়
মে’২০২৩
শেওড়া পাড়া, ঢাকা।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments