নিভে যায় নি আলো

রেহেলা: তুমি আমার মুখের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাক যেন এই আমাকে দেখে কত যে শান্তি তোমার ঐ দুচোখ জুড়ে। কী যে আনন্দ খেলা করে অন্তর জুড়ে। কতগুলো সুন্দর নির্মল অনুভূতি কোথা থেকে এসে যেন তোমাকে বিমুগ্ধ শীতল শান্তির ছোঁয়া দিয়ে যায়। আর তাতে তুমি বিমুগ্ধ হও। বলতে পারো, কী এমন যে তোমাকে এমন আত্মভোলা করে রাখে?

সৌখল:
কোথায় আছে কৈলাস, কোথায় তপোবন,
খুঁজি নাই!
কোথায় আছে মধু;
কোথায় আছে জেগে- হৃদ কলি,
উন্মাদ প্রজাপতি হই নাই!
আছে আকাশ, আছে মেঘ,
আছে তাদের সুখ-দুঃখ খেলা!
মনের মাঝে আছে প্রেম,
তাতে আছে রাজ্য;
প্রেমিক রাজার আছে-
নির্জলা কবিত্যের মধুময় শীতল সুরা!
জানো রেহালা, আমার যেনো এটাই সম্পত্তি; আমি তোমাকে আমাকে ছেড়ে ভালোবাসতে পারি। আমি যখন বাগানের ফোটা তাজা ফুল ছিঁড়ে এনে নাকের গোড়াতে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে গভীর অনুরাগে অনুরাগী হই; এর সুবাস নেই; তখন আমি আরেক আলোক ঝলমলে ধরণী দেখতে পাই। সেখানে তুমি এক ফুটফুটে কুমারী। তোমার ঘন কালো কেশের ভাঁজে মাধবী লতা গোঁজানো। সুবিন্যস্ত কালচে ভ্রূ’যুগল পরে যেন পুকুর জলেতে বাতাসের ঝিরিঝিরি ঢেউ সমেত আয়েশ। সাবলীল চোখ জুড়াতে এক দানা মেঘের শান্ত-শীতল মায়া বিছানো আবেশ। ঐ মুখের হাসিতে এক উচ্ছ্বল ঝর্ণার আনন্দ ছটা। কেবল তুমিই সেখানে। প্রেয়সী আমার, আর কেউ নেই।
জানো, আমি একবার এক ঝিলের বুক থেকে পদ্ম তুলে এনেছিলাম। আরেকবার এক বন্ধুর বাগান থেকে সাদা গোলাপ। আর এ বেলায় তোমার মনকে টেনে এনেছি। এই তিনটি ঘটনার মাঝে কি মিল আছে জানো? আমি যে আমার ভালোবাসা কে আমার করে রাখতে পেরেছি।
-অহংকার যে পতনের মূল। পরে সে ফুল মলিন হয়ে মরে যায় নি?
-গিয়েছে। আমি এতোটুকুও দুঃখ পাইনি। কাছে যেতে যেতে দেয়ালের দেখা পাবোই একবার- এটা তো জেনেছিই, তাই না? হৃদয়ের আড়ালে যে কথাগুলো, যে চাওয়াগুলো লুকায়ে ঝিলমিল করে, তার মিতালী এই জগৎ আলোয় মিশে যাবেই একদিন। তোমাকে আমার করে পাওয়াতে আমি ধন্য। ঝরা ফুলেরও একটা সৌন্দর্য থাকে। একটা নিরব বিসর্জন থাকে। যেমন তোমরা মেয়েরা, সবসময় ক্ষমা করে দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাঝে নির্মল শান্তি খোঁজে পাও। আর আমরা পুরুষরা এই অতি সূক্ষ্ম ত্যাগকে দৃষ্টিগোচর না করে বীরের মর্যাদায় আশীন হই। বাহবা কুড়াই।
-প্রেম হারজিতের মতো লজ্জা দিয়ে গড়া নয়। ও যে পবিত্র আত্মিক সম্পর্ক। মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলে পরক্ষণেই পুরো ধ্যানজ্ঞান ফতুর হওয়ার মতো স্পর্ধা। যখন তা প্রকাশ পায়, প্রেম পাপড়ি তখন কলির বুক চিরে হাসিমুখে ছড়িড়ে পড়ে। জনসম্মুখে তার সুরভি ছড়ে যায়।
-হুম।
-জানো শৌখল, আমার ভয় হয়। পাছে বহুদূর টেনে নিয়ে যদি একলা পথে ফেলে চলে যাও! তখন সেখানে আমি কেবলই আচেনা রবো। তখন ফিরবার পথটাও পানিতে ডুবা; নিশ্চিহ্ন রবে।
ভালোবাসি- এটুকুই, থাকুক নীরবে;
অশ্রুতে তাজা হোক, বিলীন হোক শুকিয়ে।
আমার আছে রাজ্য
তোমারও তাই;
জগৎ চিনে না তা-
কেবলই স্বপ্নে স্বপ্নে সজাই।
এ জগৎ জুড়ে আছে নানান ভেলকি। আর সবকিছু কখন যেন অচেনা হয়ে যায় তা ঠাহর করে উঠতে পারা বড়ই মুশকিল। পাছে বিশ্বাস চূর্ণ হলে বেঁচে থাকার স্বাদটুকুও হারাবো। আমি তখন এ হীন সইব কি করে?
মোর হৃদয় কথা কয়,
বারণ করি যতই!
মরি ভয়ে,
অথচ হৃদয়ে-
বসন্ত হাওয়া বয়।
প্রিয়, কথা দাও, তুমি কেবল আমারই। আর না হয় ফিরে যাও। হারিয়ে যাও অচেনা পথে।
তবুও মরণ নাচে পাছে পাছে,
ক্ষুধার্ত বীণ বাজে আরও করুণ করে!
প্রিয়-
বিশ্বাস রেখো- ছলনা নয়!
বিস্তৃত মলয় উঠুক নেচে,
হাত খানা টুটিয়া না লয়!
আমার যত আকুলতা বুঝি-
তোমায় করেনি ব্যাকুল?
প্রিয়-প্রিয়-
এই হীন জানিবো কী সদাই?
চন্দ্র এনেছে রাত, প্রভাকর এনেছে দিবা;
হৃদয়ের কোন খেলায় আনিবে ব্যর্থতা…
-ওগো, ওগো আমার শুকতারা।
পাছে ফিরে দেখো-
কোন স্থানে,
কোন ক্ষণে,
কোন বাসনাতে-
নেইকো তুমি;
নেইকো সাড়া জাগানিয়া সাড়া?
প্রিয়- আছে,
সর্বত্রই আছে লেখা মোদের প্রেম গাঁথাই।
রেহেলা, সূর্যের প্রখর তাপ আছে জনি। সবকিছুকে পুড়িয়ে নেওয়ার ঔদার্য আছে, তাও জানি। তাই বলে কি আমরা দিনকে চাই নে? গ্রীষ্ম পার করে শীতের পরশ পাই না? দূর দিনের কথা ভেবে প্রিয় আজকের দিনের মাঝে ভয় প্রবেশিয়া কী লাভ- বলো?
-ঐ ভয় টুকুই যে একজন নারীর সম্পদ। আমাদের মন মরে যাওয়া মানে মরে যাওয়া, তা তোমরা বুঝবে না। জানো শৌখল, ছেলেদের শক্ত বাহুর আড়ালে মিথ্যে অভিনয় টুকুও থাকে।
-তবে কী এটাই শ্রেয়, আকাশ থেকে বজ্র ঝড়ে পড়বে বলে ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকা?
-প্রেম যুদ্ধ জয় নয়! প্রেম হলো পরাধীন আর অচেনা হওয়ার জোছনা খচিত মায়াময় মালা।
-মেনেছি।
-বরং এই আছি বেশ।
-বেশ। তবে তাই হোক।
(রেহেলা প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। তার নিরবতা এটাই বুঝা গেলো সে মুক্তি চায়। যা একটি খাঁটি প্রেমের মৃত্যু জন্য করুণ চিত্র।)
-চললুম। তবে, শেষ কথাটা বলে যাই। পথিককে চিনতে হয় অন্তর দিয়ে। আমারে বাহিরে ঠেলে দিয়ে বাহির দিয়ে চিনলে! বাহির টা যে বর্ণিল।
-আমার ঢের চেনা হয়েছে। তোমরা ছেলেরা অতি নির্দয়। মিষ্টি কথার ফুলঝুড়ি যেমন গড়ো, ঠিক তেমনি হৃদয় ভাঙার সমস্ত আয়োজন তোমাদেরই পরিকল্পনার অংশ।
-ছি! এমন হীনে সকলকে একপাল্লায় মেপে দেখো না। মন যেহেতু সবারই আছে। তাই ওর উলটো পিঠটাও থাকে। তবে সামান্যই হতচ্ছাড়া হয়ে থাকে।
-মালা ফুপি(পড়শি), অবিশ্বাসের বিষ সইতে না পেরে জীবনের মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। কী অপরাধ ছিল তার- বলো! বিশ্বাসই তো করেছিলেন। এ বিশ্বাস তোমাদের মতো পুরুষরাই ছিঁড়ে ফেলে।
-আজ তুমি যে অভিযোগে আমাকে জড়ালে, তার কথার জবাব দেবো না। এ আমার ব্যর্থতা; সরল ভালোবাসা ঘেরা উষ্ণতা তোমার হৃদয়কে সজাগ করতে পারেনি। তবে, পুরুষ সম্পর্কে তোমার ঢালাও অভিযোগ কেবলই অবান্তর এ তুমি নিজেও জানো হয়ত ।
এর দুই মাস দশ দিন পর-
রেহালার চিঠি:
হে, প্রিয়তম! হে আমার আলো। তুমি আলোই। তুমি আমায় গ্রাস করে রেখেছ। এভাবে আমি তোমার হয়ে গিয়েছি, তা জানা ছিল না। আজকাল আমি নিজেকে হালকা অনুভব করি। আমি যেন তুলোর মতো উড়ে চলা মেঘ। আমার মনের ভিতরে আছে এক উদাসীনতা ভরা স্বপ্নাতুর ভেলা। তুমি, কেবলই আমায় উড়িয়ে নিয়ে চলছো। আমি কেবলই তোমার সাড়া পাই। আর এই পরাধীনতার মাঝে কেমন যেন একটা সুখ শীতল অনুভূতি জড়িয়ে আছে। তোমার কথাগুলোই কেবল গুনগুন করে বেঁজে সর্বত্র চিৎকার করে উঠে। আমার ভেতরকার আমি অবলীলায় বলে উঠি- আমি তোমারই প্রিয়; আমি তোমারই।
আমার ভেতরকার সংশয়গুলো সুবাসিত ফুল হয়ে ধরা দিয়েছে। আমাকে আরও বেশি উজ্জীবিত করে তুলছে।
প্রিয়-
তুমি কোথায়, কোন বনের আড়ালে আছ-
উতলা সুরে ডেকে?
পূবে যাই, পশ্চিমে যাই,
উত্তর খুঁজি, দক্ষিণেও নাই?
এক সগর ঢেউ-এ তবুও আশ্রে আশ্রে পড়ো!
ফের ফিরে আসো সুকতারা হয়ে
নীরবে বিলিয়ে যত কথা
স্বপ্ন মঙ্গল প্রদীপ জেলে জেলে!
ওগো পুণ্যবান। ওগো ঘুম জাগানিয় পাখি। ওগো ধ্রুব তারা। নিঃশ্বাসের কলি ছিড়ে উঠা স্বপ্নাতুর স্নিগ্ধময় পরশ। এক দণ্ড দেখা দাও। তোমার সুমধুর আওয়াজে বিজলি সম পরশ দিয়ে যাও। আজ আমি বড্ড বেশি ক্লান্ত।
একথা ওকথা মিশে থাক মেঘ হয়ে।
আবার মেঘের আড়ালে থাকা আকাশ নীল হয়ে-
হেসে ভেসে উঠুক মেঘ চুঁইয়ে চুঁইয়ে।
ওগো প্রিয়, প্রেম দূত হয়ে মেঘের নব নব তারুণ্য কিরণ ফোটে উঠে যেমন করে, তেমন করে ফোটে উঠে ওগো তোমার অবিমিশ্রিত কথার মালা পুষ্পাঞ্জলির সুরভে । তোমার চোখের প্রখর দৃষ্টি আমার অন্তরকে কেবলই দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় শক্ত পরশ উন্মুক্ত করে।
আজ আমার সব কথা মিশে যায় একটি কথায়। সব স্বপ্ন ঘিরে উঠে একটি স্বপ্নকে ঘিরে। জীবনময় শত দায়িত্ব একটি দায়িত্বে হাবুডুবু খায়। কেবলই চোখের সামনে একটি ছবি প্রতিচ্ছবি হয়ে ভেসে উঠে। দিগন্তজুড়ে সবুজ মাঠ; তার উপার রয়েছে বাগান ঘেরা ছোট্ট বাড়ি। সেখানে থাকা ঘরময় আছে আলো আর আলো। পাখির কিচির-মিচিরে ভরা। প্রতিটি মুহূর্ত আমার করে তোমায় পাওয়া সেখানে। তোমার ডাগর ডাগর চোখগুলো বারেবারে ফিরে আসে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে। তোমার কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ভেসে উঠে এ দেয়ালে ও দেয়াল থেকে থেকে।
শৌখল, আমার এ ব্যাকুলতা আমাকেই ছাপিয়ে যায়। এতে তোমার কোনো দায় নেই। আমি নিজে নিজেই অগাধ জলে ঝাপ দিয়েছি। আমি মনে করেছিলাম- এ ঘোলা জল, সামান্য গভীর। অথচ এ ঘোলা জলের গভীরতা মাপতে আমার জীবন সর্বস্ব দিয়ে দিলেও কোলোবে না। প্রিয়, যে মিনতি প্রাণ বাঁচানোর তাকে আমি ঘৃণা করি। কিন্তু যে মিনতি হৃদর বাঁচানোর তাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।
ঠিক আছে, আমার ব্যাকুলতা যদি শুধু আমাকেই ঘিরে থাকে; তোমাকে যদি তা স্পর্শ না করে, তবে তোমার কাছে কোন চাওয়া নেই। আশা নেই। যদি তোমাকে ঐ একই বেদনা ব্যথিত করে, ব্যাকুল করে; তবে জেনে রেখো আমার হৃদয়ে জাগা অনুভূতিগুলোর আশ্রিত ফুল তোমার মুখ পানে চেয়ে রয় কেবল। তোমাকে এক দণ্ড দেখার জন্য অধীর আকুলতা ভরা চিত্ত আঁচল বিছিরে রয়েছে। তুমি সত্য সূর্য আমার।
কত যে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়,
প্রদীপ জ্বলে আবার নিভ যায়:
দিনের আলোয় ধরণি মেতে উঠে,
কর্ম প্রেরণা কেবলই সম্মুখ ধার।
অতীত সম্মুখে আসে অস্পষ্ট মূর্তি হয়ে,
মুছে যায় কোনো এক ঘূর্ণিপাকে।
সবই ফুরার, সব হিসেব চুকে যায়;
শুধু পড়ে রয়, জেগে রয়, মিশে রয়,
ছলে বলে আলোর আঁধারে ডুবে।
ওগো প্রিয়, তুমিই আলো আমার।
এ হৃদয় জুড়ে শুধু তোমারই বিচরণ!
প্রিয়-
মোর, মিনতি ভরা ফুল নিও
আকুলতা নিও
শতরূপে কল্পনা নিও
উজ্জ্বল আনন্দটুকু চোখে এঁকো!
ওগো প্রিয়, এহেন কুর্নিশ যা হৃদয় পোড়ানো ধুপ হয়ে প্রতিনিয়ত তোমাকে হারিয়ে ফেলার জটলার ধোঁয়া হৃদয় আঙিনাকে আঁধারে ডুবিয়ে ফেলে। সত্য সুন্দর হাসি মাখা প্রাচুর্য যে এরই মধ্য থেকে উঁকি দিয়ে উঠে, যা কেবলই এক চিলতে আশাকে ধামা ধরায়। তখন আবার সমুদ্র জোয়ারের মতো এক অন্যরকম আনন্দ ধারা খোঁজে পাই। সকল বাঁধার দেয়াল টুটিয়া তোমাকে জয় করার উল্লাস কে প্রকাশ করার তীব্র সাধ-এ পরিণত হয় তখন। তবুও প্রিয় যেন, তোমাকেই বারেবারে হারাই।
ওগো প্রিয়, আমার হৃদয়ে যত হীন তা আমার সৃষ্ট নয়। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে পরিচিত জনের সংস্পর্শে পাওয়া উতলা বিষাদ কেবল। যা হয় তাই ভেবেছি; যা ঘটেছে তাই দেখেছি। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু আমিও দায় যুক্ত নই। তবে দায় এড়ানোর পরিস্থিতিও নেই আমার। এই সমাজ চৌহদ্দির চোখের সামনে ঘটা ঘটনা ও অনুভূতিগুলো অতি যত্নে সামগ্রিক বিচারিক সিদ্ধান্ত দেয়। আমি তো নারী। সর্বদাই তলেতলে শীতল আশ্রয় প্রার্থনা করে চলি। তাই যেখানে ভালোবাসাটুকুই সম্পদ, সেখানে ভয়ের মাঝে স্বচ্ছ বিশ্বাস কিংবা বন্ধনটুকু খোঁজে নেবার প্রয়াস থাকেই।
পাছে ফিরে দেখি,
সকল হিসেব-নিকেশ চুকে গিয়েছে মোর
দমকা হাওয়ার ঝড়ে।
প্রাণ বাঁচুক কিংবা না বাঁচুক
হৃদয় মুক্তি আসুক প্রদীপ জেলে।
আমি ঠিক আমাতে নেই। আমার ভেতরকার আমি সর্বদা মূর্ছা যাচ্ছি দমকা দমকা বিষাদ ঘেরা রক্তাক্ত হৃদয় পাপড়ি মেলে।
সত্যিকার পরাজয় মেনেছি হে প্রিয়,
আধার থেকে আলোতে মুখ তুলে।
কলি ছেড়ে যে ফুল ফোঁটলো হাসিমুখে,
তার কেবল তোমারই অধিকার।
বিদ্যুৎ সম বিচ্যুতি করো না আর।
একেলার বাঁশির করুণ সুর আজি,
বে-সুরা সুরে বিদ্রুপ লাগে ভারি!
কোন বিজনের আড়ে বসি আছো-
মম বেদন তুচ্ছ করি।
হৃদয় দোলাকে হেলা করেছি সেদিন। জানবার অবকাশ হয়নি। অথচ আজ সূর্যালোর তলে মেঘের আশ্রয় বিনা প্রাণ যে মরে। আশফাশ চারদিকটায়। ক্ষমা করো প্রিয়। সর্বাঙ্গ চিত্তে ক্ষমা করো আমার হৃদয় বিজয়ী- প্রিয়।
আমার কথা তোমার প্রাণে যদি এতোটুকু জাগে তবে মনে রেখো-
মোর বেলা অস্ত গিয়েছে
তোমার প্রাণের গভীরে/আধারে;
সর্ব চিত্তে মন্দির মেনে।
আজিকার শত কথাগুলো
ডুরিয়া আছে- তোমাকে পাওয়ার
প্রার্থনা সংগীত হয়ে।
এ অশ্রু সামান্য জল নয় কো;
নিখাত প্রেম গজিবার যতটুকু আবা,
ততটুকুই কষ্টি কর্ষণে বর্ষণ!
ফিরে এসো বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায়;
রবে আঁধারে; আলো জ্বেলে নয়!
একান্ত আত্মা একাত্ম হয়ে
আঁধারে ডুবে যেন প্রাণে প্রাণ!
ঘুমটা পড়া ফুলের কলি সূর্যাষ্ণতার সাড়া দিয়ে ফুটে উঠে। সে ফুল, ঐ আলার সাড়ায় উন্মুখ হয়ে থাকে। আমার প্রেম নিও হে প্রিয়, তেমনি উতলা ভরা পাপড়ির হাসি, সুরভি নিও। নিও!
ছুটিয়া আসো না হয় ক্ষণ কাল জুড়ে,
নতুবা ঐ পথের দিক দাও- যাই চলে।
একুল-ওকুল কেবলই রব তুলেছে আজি!- আর কেবলই বলে-
নাই নাই নাই!
দু’চোখ জুড়ে নাই।
ওগো প্রিয়,
এহেন দীনে দানে গর্বিত করো
প্রজ্বলিত উষ্ণ ধারায়। প্রিয়..
প্রতীক্ষা হলো ভারি শীতল শক্ত পাথর।
তোমার তরে বসন্ত মেলে প্রতীক্ষায় আছি খালি হত দু’টো মেলে; জেনো- হে প্রিয়।
সে পাথরটাও আজ তরল হয়ে হাসিমুখে উদ্ভাসিত হতে নির্লিপ্ত আকুতি জানায়। প্রিয়…প্রিয়!
সাড়া দাও!
ইতি
তোমার পন্থপানে প্রতীক্ষামান প্রেম ভিখারি
রেহালা
শৈখলের প্রত্যুত্তর চিঠি:
হে কামিনী ফুল, তোমার এই আকুতি ভরা আনন্দ আয়োজনের সুবাস আমার হৃদয়ে এসে সুবাসিত করে তুলছে। আমি বিমোহিত। একই সাথে আমি সংকুচিত তোমার ডাকে সাড়া দেবার বিলম্বে। হৃদয় হৃদয়কে চিনে নিয়েছে বন্ধু। আমরা কেবল দুজনে দুজনের প্রতি পরাধীন। রাজ্য রাজা সবই আছে, শুধু মুকুট টা চুরি হয়ে গিয়েছে। কাজে কাজেই এ বিচ্যুতি বেদনা যথার্থ সমীচীন। এ চোখের অশ্রুটুকু নদীর ধারার মতো কেবল তোমার দিকেই বহমান। আজ কোকিলের সাড়া তুলা সুমধুর সুরেলা ডাক কেবল তোমারই কথা মনে করিয়ে দেয়। তোমাকে আরও বিস্তৃত করে পাওয়ার প্রেরণা জাগায়।
তুমি কত যে মধুর, প্রাঞ্জলা। মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত কিছুই যদি হীরে-জহরতের আলোয় ঝলমল হয়ে উঠে; তবুও তার মাঝে তুমিই অনন্য। এমন কি তুমি যদি হাজার টা আঁড়ালের মাঝে- লুকিয়েও থাকো; তবুও তোমাকে আমার এ চোখ, এ হৃদয় চিনে নিবেই। তুমি আমার নির্জলা আরাধনার প্রেমটুকু। আমার হৃদয়ের হাজারো দুয়ার যদি একই সাথে খুলে যায়। আর যদি এমন হয়, সমস্ত অনুভূতিগুলো পেরেশানিতে ক্লান্ত হয়ে উঠে। সমস্ত অরণ্য জনসমুদ্র হয়ে স্লোগান তুলে। কলরবে কলরবে অর্থবোধক শব্দ মিশে গিয়ে অন্যরকম বিস্তৃত মোটা শব্দে পরিণত হয়। সেখানেও তোমাকে ঘিরে থাকা অনুভূতিরা প্রেম ডালায় ফুল মালা গেঁথে কোরাস গাইতে থাকবে। তোমারই প্রেমে মনোরঞ্জিত হতে থাকবে। তোমাকে মক্ষীরাণী করে চুমিয়া নেবার তীব্র প্রলয় হবে সেখানে।
সেদিন ছিল সান্নিধ্যের আবহে ভরা ক্লান্ত দুপুর। আমি বাগানের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সদ্য ফোটা সুবাসিত সতেজ একটি ফুল আমার হৃদয়কে পুলকিত করে তুললো। দ্রুত কাছে গিয়ে ঝটকা টানে ছিঁড়ে আমার করে নিলো। তৎক্ষণাৎ, গোলাপটিকে দু’হাতে চেপে চোখ বন্ধ করে হৃদয় দুয়ার খুলে নাকের ড়গাতে তুলে ধরতেই নাসিক্য সুগন্ধিতে ভরে উঠলো। মন হারিয়ে গেলো এক অন্যরকম স্বপ্নীল পৃথিবীতে। সেখানেও দেখি তুমি; ঠিক তুমি-তুমি! আর তোমায় ঘেরা এক ঝলমলে রাজ্য। সে রাজ্যের রানি হয়ে মুকুট পড়া ঝলমলে প্রেয়সী- তুমি। সেখানেও দেখি, রাণী হয়েও আমার বিহনে সমস্ত কিছু মলিন করে রেখেছ । আমি যেন তোমার প্রাণ চৈতন্য ফুলের আনন্দ ভ্রমরা। শেষে, আমাকে পেয়ে তোমার যেন প্রফুল্লতা ভরা আনন্দ উদ্বেলিত পতঙ্গের মতো ডানা ঝাপড়ে আনন্দ মূর্ছনা প্রকাশিত হতে লাগলে। তুমি আমার হৃদয়ের কতটুকু আনন্দ সম্ভারে মূর্ছনা ছড়িয়ে আছো তা কেবল বিধাতাই জানেন।
খুব করে ইচ্ছে করে, তোমায় দেখতে। এ চোখ চায় একটা বাধার দেয়ালে জ্যান্ত ছবি। কান শুনতে চায় সম্মুখ স্থান থেকে সুমধুর আওয়া। সে আওয়াজ এসে প্রবেশ করুক হৃদয়ে; আন্দোলিত করে যাক বিস্তৃত অনুভূতিগুলোকে আরাম দিতে দিতে। কিন্তু সুরেলা কোকিল হারিয়ে যেতে যেতে আজ এ চোখ বন্ধ করলেই যে ছবি ভেসে উঠে, সেখানেই তোমাকে ইচ্ছে মতো সাজিয়ে রাণী রূপে পেতে চাই বটে, কিন্তু জ্যান্ত রূপে পাওয়ার চাওয়া নয় আর! এ আশা আজ বড্ড দূরের স্মৃতিময় মেঘলা আকাশের ওপারের নীল। এই নীল আপন করে চাওয়ার কিন্তু দাবির নয় আর…! এই মন মেনে নিয়েছে। অতৃপ্ত হৃদয় ছুঁয়ে পরশ নিতে চায় বটে, অথচ বহু দূরের- তুমি দূরের।
যে কথাগুলো বোবা; কিছু কাল আগে মৃত হয়ে এখনও জ্যান্ত হয়ে ভেসে আছে। তার বচন আছে কিন্তু ধ্বনি নেই। তীরের ফলার মতো বুকে এসে বিঁধে ব্যথা জাগায় কিন্তু তা সর্বাঙ্গ মিশে যায় এমন নয়।
গুরগুর ধ্বনি বাজে প্রাণে,
দীপ্তিময় স্ফুলিঙ্গ ধেয়ে ছুটে।
হায়- এরই মাঝে ফুল-
কলির বুক ছেড়ে পাপড়ি ছুটে ত্যাজে-
সুগন্ধি আভা হয় বেগবান!
এক হাতে খঞ্জর, আরেক হাতে মালা,
প্রেমে হৃদয় হয়ে উঠে যুদ্ধের থালা!
এই গোলমেলের মাঝে আশার আলো-
ঝলকায়ে উঠে- হায়;
প্রেম, তরুণ হয়ে চেয়ে- বেঁচে থাকে প্রাণপণে।
তবুও দূরেই রও। আমার চোখ গড়িয়ে ঝরে পড়া অশ্রু তুমি এসে মুছে দাও তা আমি চাই না। অশ্রু যেহেতু আমার অন্তর কর্ষে আমারই চোখ ভেসেছে, তাই আমার শরীরেই মিশে যাক। কারো হাতে পড়ে করুণা সৃষ্টি করুক তা আমি চাই না। শুকনো পাতা ঝরে পড়লে তাতে কার কি আসে যায় প্রিয়? সেই মরা পাতার দুঃখ টাই আর কতটুকু? এক সময় সে পাতার হৃদয়গ্রাহী উন্মত্ত তরঙ্গ ছিল। তারও তীব্র চাওয়াগুলো এক সময় সজীব ছিল। এখন আর সেই সজীবতা নেই। তবুও তার কিছু চাওয়া আজও বেঁচে আছে। এখন তা ধূসর। নূয়্যমান। শেষ বিকেলের ক্ষমা টুকু। হৃদয়াঞ্জলি দেবার চেষ্টা টুকু/ব্যগ্র। সে পাতার যৌবন কালে তাকে ছিঁড়ে নিয়ে কেউ আপন করেনি তো। তবুও প্রার্থনা, আজ ঝরে পড়ে গিয়েও যেন সেই আপন বৃক্ষের তলে প্রেমের যত্নটুকু অবলীলায় মিশে দিতে চায়। তার শেষ মিনতি এই যে, প্রেম টুকুও বৃথাই আড়ালে মৃত্যু না হয়।
রেহালা, তোমাকে জানার পর থেকে আমার ভেতরকার একটা দাবি অতি তীব্র হয়ে ধরা দিয়েছে। আর, তুমি যেদিন আমাকে তোমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করলে, সেদিন থেকে তোমাকে আমি যেন পেলাম। তখন বিশ্বাস টুকু ঠুনকো হয়ে অধিকারটুকু বড় হয়ে দেখা দিলো। বিস্তৃত হয়ে ধরা দিলো। আজ অবধি স্রোতের ধারার মতো আমার সকল ধ্যানের চূড়া- তোমার অভিমুখে। এমনকি ঘুমের অবচেতন চৈতন্য সুর তোমার মুখপনে মন্দির তপে।
ওগো প্রিয়, প্রাণের প্রাণ হে,
চাইতে চাইতে আপন হলে!
বেধেছিনু ছোট্ট আশা, বাসা। আবার-
টুটে দূরে ঠেলে দিলে।
তখন তোমা হতে দূরে এসে
তোমারই মতন খুঁজে পেয়েছি
টুকরো টুকরো তুমিই!
খুঁজি কখনো তৃণাশ্রিত চোখ,
কখনো দেখি ঘন কালো দমকা কেশ
চাঁদের পাশে বিছানো।
ধীরে ধীরে আসা, গভীর করে সে চাওয়া,
বায়ু থেমে গিয়ে- দমকা ছাড়িবার প্রাশ!
এহেন কার্য দিন-রাত্রি আসে বারো মাস;
তোমাকে পেয়ে আবার ছাড়ি, ফের পাওয়ার ত্রাস!
সরলা সুর তোমার কোথা থেকে ভেসে আসে,
চকিত, চনমনে ফিরে ফিরে খুঁজি এমন,
নাইকো কোথাও; ফের বিষণ্ন লাগে ভারি,
আবার নানান কথার খেয়ালের হাসি রাশ।
দূর, বহুদূর, দূরান্তে গিয়েছি,
পত্রপল্লব ছাড়ি দূরের সীমানা পাড়ি জমি!
জলরাশির কলরবে ডুবি ডুবি; তবুও-
হেথায় কেন মূর্ছা যায় সমস্ত চূড়া মাড়ি!
তোমার নীল চোখ নীল সাগর করেছে চুরি!
জানো রেহেলা, আমি তোমার মাঝে তোমার থেকে যা খুঁজে পেয়েছি তা আমি সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুঁজে পেয়েছি। এ বড় বিব্রতকর; এ বড় আসক্তি- প্রেমের। আমি যে চৈতন্যের সকল দুয়ার টুটে আবার তোমাকে পেয়েছি বিস্তৃত করে। এ তোমার কিংবা আমার প্রগাঢ় প্রেমের খোল ছাড়া তলোয়ারের নৈপুণ্য ভরা বিষাদ যুক্ত বিচ্যুতি। তুমি নেই; অথচ আছো। আমার হয়ে আছো চির চেনা সেই তুমি। তুমি আছো প্রশ্বাস সম দূরে।
কী যুগে বাধিলে পিরিতি মালা,
নয়ন তারাতে ফুটে শুধুই একটি ফুল;
শতরূপে পাই খুঁজি, শতরূপে ছাড়ি,
মধুর জোয়ারে, বিষের নীলে- হায়-
জেগে উঠো সদা তুমি-ই…
রেহেলা, আমি যখন মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়ে দেখি আর যাবার পথ নাই। সম্মুখে শুধু গনগনে অগ্নি শিখা। সেখান থেকে ফিরে আসার প্রাণপণে প্রার্থনা করেছি। তীব্র প্রতিরোধ গড়েছি। অবশেষে স্রষ্টা আমার পাগল করা সকল অনুভূতি নিয়ে গিয়ে কেবল তোমাকে ঘিরে স্বপ্নাল্পনা আঁকার এক অন্যরকম পথ দেখিয়ে নিয়েছেন। এখন যে রূপে চাই, সে রূপে পাই তোমায়। এ হলো আমাকে দেয়া অন্ধ ভালোবাসার মুক্তা খচিত স্বপ্নাতুর ঝলমলে তারাময় উপহার। কাজেই, তোমাকে আর হারিয়ে ফেলার ভয় এখন আর তাড়া করে না। বরং আগে তোমার ভালোবাসা মিশে ছিল; আর এখন তোমার ভালোবাসা গেঁথে আছে। এ সত্যিই মধু মিশ্রিত অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া।
রেহেলা, আমার অশ্রুশিক্ত নয়ন বলছে, কেবলই ধৈর্য ধারণ করতে। কিন্তু এ হৃদয় বলছে- কোথায় সে; কোন দিগন্ত পরে। কোন চূড়ায় আছে সপ্ত দেয়ালের আড়ালে। সেখান থেকে ভেঙে আনো তারে। এ শক্তি/প্রেরণা যে কেবল আমার মুক্তির বিজয় পতাকা মাত্র। কিন্তু এই ক্ষণ, এই অশ্রু, এই হৃদয় সে সকল কিছু কে ছাপিয়ে ঐ অন্য পৃথিবীতে খুঁজে পেয়েছে তোমায়। সেখানেও তুমিই মুনিব। আজও তা ঘিরে বাসর সাজিয়ে তোমাকেই এক অপূর্ব লীলাময় আসরে বসিয়ে রেখেছে।
প্রিয়, ভালোবাসি,
তোমার ঐ হাসি, কথা, ভর্ৎসনা!
প্রিয়, তোমার দেয়া-
অতি সামান্য স্বপ্নটাকেও ভালোবাসি।
প্রিয়, তোমার-
নিস্তব্ধতা কে ভালোবাসি।
অথচ তোমাকে পাওয়ার ব্যাকুলতা
বিস্তৃত আলোর মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে।
প্রিয়, তোমাকে ভালোবাসি,
প্রচণ্ড ভালোবাসি…
ইতি
শুভ্রতা ছিটানো তারা
শৈখল।
রেহেলার প্রত্যুত্তর চিঠি-
“আমি অপেক্ষায় রবে। শিমুল ফুল ঝরে পড়ে শুকিয়ে গেলেও শিমুল গাছ আবার বসন্তের অপেক্ষায় থাকে। কোকিল ফিরে না এলেও আরেক বসন্তের…
ইতি
মগ্নতাময় প্রতীক্ষিত তারা
রেহেলা।
ছোট গল্পঃ নিভে যায় নি আলো
কলমেঃ তারিকুজ্জামান তনয়
ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *