
(০১)
স্ত্রী সূচনা পা টিপে টিপে হেঁটে ঘরময় পায়চারি করছে। ছোট ঘর অথচ পায়চারিতে ক্লান্ত হয়ে উঠছে। বুঝা যাচ্ছে কাজ বেশি নয়, তবে বাহানা বেশি।
অন্যদিকে তার স্বামী কবির বিছানাতে সুয়ে সুয়ে স্ত্রী সূচনার রাগ হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে।
-বুঝতে পরেছি, ঝড় খুব সন্নিকটে।
নাহ! কবিরের এমন খোঁচা দেওয়া কথাতেও সূচনার গোমরাহ ভাবের কোনো পরিবর্তন এল না।
–প্রভাতেই আলো এসেছে বটে,
তাতে মেঘ করেছে আড়ি;
ফুল ফুটেছে টলোমলো,
তবুও প্রেমময় কথার মালা সাজেনি!
-এমন ফিসফিস আওয়াজ ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো। আমাকে কাজ করতে দাও।
-জীবনট-ই তো কাজ আর কাজে পরিপূর্ণ। প্রিয়জনের পাশে বসাটাও কিন্তু একটা কাজ। আর আমি মনে করি এটাই সবচে বড় কাজ।
সূচনা কিছুটা কৌশলী করে বললে- একটু পরেই তো বলবেন, কাজে-কম্মে কোনো মন নেই! গতি নেই! এত সময় লাগে? অথচ মেয়েদের কাজ কত যে বেশি। ছেলেদের চোখে তা ধরা পড়ে না। ছোট ছোট কাজগুলো করতে সময় লাগে না- বুঝি!
-আচ্ছা সূচনা, একদিন নাই বা কাজ করলে; সকাল বেলা নাই বা খেলাম। না হয় অফিসে গিয়ে দুর্নাম ছড়িয়ে দিলাম- বিয়ে করে কোনো ফল হলো না। সেই অফিসে এসেই নাস্তা সারতে হয়।
-তবে তাই হোক!
-তা না হয় হলো। দুর্নাম না হয় ছড়ানো গেলো। কিন্তু যে সময়টুকু রান্নার কাজ থেকে বেঁচে গেলো সে সময় টুকু তো পাশে পাওয়া চাই। অবসরটুকু চোখে চোখ রাখা চাই।
-সে সময় কি তোমার আছে? সকালে উঠে অফিস অফিস। রাতে ফিরে নিরবতা। তারপর সকাল ওঠে আবার অফিস অফিস।
-পড়ে থাকুক গে সব কাজ,
নিখিল হোক-গে ধ্বংস;
প্রিয়া মোর এসেছে কাছে,
সব ফুল ফোটে উঠুক-
সময় চেয়ে দেখুক আজ স্তব্ধ!
(০২)
নারী চরিত্র বড় সরলা। সুরেলা কণ্ঠ শোনাতে পেলে তারা বিনয়ী হয়ে ওঠে। সূচনার মনে জমে থাকা ক্ষোভগুলো নিমেষেই ভুলে গেলো।
-বসেছি গো পাশে,
কি কথা শোধাবে- বলো?
হাজার খানিক কাজ আছে যে পড়ে!
-বধূ টি মোর লক্ষ্মী,
ফু-ল কলি নাও;
আর নাও টুকটুকে গোলাপ!
হৃদয় সঁপেছি গো পবিত্র রূপে,
আরও নাও দগ্ধ হৃদয়ের উষ্ণতা;
প্রেম নাও গুনে গুনে।
জানো সূচনা, একটি টুকটুকে গোলাপ পাখির ঠোঁটে করে এনে তোমার খোঁপায় পড়িয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে-
“আর সারা বেলা ওদিকে পড়ে থাকুক শত কলরব নিয়ে,
আমার সখী আমার করে থাকুক প্রাণে-মনে মিশে।
শুধু এতটুকু কথাতেই হৃদয়ে এলো না তৃপ্তি,
হায় সূচনা,
পলাশ ফুলের সুশ্রী রং তোমারই রঙ।
শিমুল-পলাশ ফুটেছে বসন্ত হাওয়ায় মেতে;
কোন বাগানের কোন ভোমরা শোনায় গান-
থাকুক তারা আপনি আপন করে!
ফুলের হৃদয় চিরে দেখিনি কো কেন এত হাসি,
চাঁদের বুকে ঝলমল আলো- কোন কারণে মায়া অতি?
সূচনা, তোমায় যত দেখি চোখের আলোতে,,
আর যত শোনি মুখের ঐ সুশ্রী কলরবটুকু; হায়-
কেন বাড়ে মায়া, কেন সমুদ্রসম অতল!
তোমারে, জনম-জনমে ভালোবাসিবার মিটিবে না সাধ!
(০৩)
-সবই তো বোঝা গেলো। বেলা যে যায় বয়ে। এবার বলো, কী উদ্দেশ্যে এমন রসালো কথাচ্ছলে কাছে ডেকে নিলে?
-সবার সাথে কি আর নিয়ম চলে। নিয়ম তো বাহিরের জন্য; আপন জনের জন্য নয়। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে নিয়মের বাণী পুস্তকের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে।
-নিয়ম করে যদি বেশি সময় পাওয়া যায়, তবে আপনজনের সাথ নিয়মই ভালো।
-সে মন্দ নয়। তবে আপনজনের সাথে সময় নিয়ে দ্বন্দ্বের নাটকীয় ব্যাপারটা একেবারে মন্দ নয়। দুই-একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া বেশ কিন্তু।
-যে মেনে নেয় সে জানে সময়ের অবহেলা কতটা বেদনার; কতটা যন্ত্রণাদায়ক। থাক ওসব। এবার তো বলেন- কী কারণে ডাকা?
-কি বলবো?
-ডেকেছেন কেনো?
-আচ্ছা, সারাদিন একলা এই ঘরে কী করে কাটে?
-একটু কাজ করি; আবার একটু আমার জামাইয়ের মুখের ছবি আঁকি।
-সত্যিই।
-হুম। সত্যি।
-কি ভাবে?
-মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, তুমি পাশের রুম থেকে আমাকে ডাকছো। ঠিক স্পষ্ট সুর। আমি অবচেতন ভাবে সাড়া দিয়ে ফেলি। প্রত্যুত্তর না পেয়ে হাসি। আবার চুপটি মেরে বসে থাকি।
(০৪)
-আচ্ছা! মাঝে মধ্যেই এমন বলো, এই মাত্রই ফোন হাতে নিয়েছি আর কল চলে এসেছে অথবা এসএমএস এসেছে। কিংবা বলো, মাত্রই মনে পড়েছে। এটা কি ভালোবাসার শক্তি?
-আমি এতো কিছু বুঝি না। ফিরে ফিরে শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। পৃথিবীটা বড্ড বেশি রহস্যময় মনে হয়।
-জানো, গত পরশুদিনের কথা। অফিসে কাজের ফাঁকে তোমার কথা ভাবছিলাম। ঠিক ভাবতে চেয়েছিলাম এমন নয়; কিন্তু ভাবা হয়ে গেলো কেমন যেন। মনে হচ্ছিলো তুমি আমার কাছে কিছু একটা দাবি করবে। আর আমি তা পাশকেটে যাবো।। ঠিক তৎক্ষণাৎ তোমার কলের উপস্থিতি। বললে, বোরখা ঠিক করতে যাব। অফিস থেকে একটু আগে বের হওয়া যায় না? আমি আশ্চর্য হলাম।
-তুমি কি বললে তখন! (কিছুটা রেগে)
-তখন ঠিক বলেছি। বের হওয়া যায়, তবে স্ত্রীলোক নিয়ে রাতের বেলা বেরুতে নেই। তুমি তখন হ্যাঁ-ই-কাঁ-ক এমন শত শব্দ ছড়ালে। স্ত্রীলোক সত্যিই জাদুকর। বিশেষ কোনো পরিশ্রম ছাড়াই জয়ের মালা গলায় পড়তে পারে। অবশেষে সেদিন যেতেই হলো।
-আবারও যেতে বলেছে কিন্তু!
-আবার কোনো এক সন্ধ্যার অপেক্ষায় রইলাম- ঠিক আছে? দেখি সেদিন হৃদয় আত্মা কী বলে? নিশ্চয়ই সেদিনও পার পাবো না!
-জি জাহাঁপনা। এবার গোসল সেরে এসো। পরে বলবেন, স্ত্রীর লাগি বেলা বয়ে যায়!
(০৫)
-জানো সূচনা, আমি সত্যিই আমার পরিচিত যে যে বিয়ে করার উপযুক্ত আছে, তাদের প্রত্যেককে গিয়ে গিয়ে বলে আসবো যেন তারা কোনো সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে না করে। সুন্দরী স্ত্রীকে দু’চোখে দেখতেই ভালো লাগে, কথা বলতেই ভালো লাগে, পাশে বসতেই ভালো লাগে, কবিতা আবৃতি না পারলেও কবিতা শোনাতে ইচ্ছে করে। অন্যদিকে সময়, সে তো সবজি কাঁটার মতো নির্দয় ভাবে কেটে কেটে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। সব সময়ই দেরি হয়ে যায়। আগে, জীবনটাকে ভাবতাম গোলাপ ফুল; এখন দেখি জীবনটা তেজপাতা। সময়ের দৌড়ে শুকনো, মলিন, নীরস।
-জি জাহাঁপনা। বাসায় যে অল্প সময়টুকু দেন তা অফিসে ব্যয় করে আসলেই পারেন। এ সময়টুকুর জন্য বসায় আসার প্রয়োজন কি?
-দুঃখ তো ওখানেই। বিধাতা চাঁদনী রাত দিলেন বটে, তবে মেঘের আঁচল সরিয়ে দিলেন না।
স্ত্রী লোকের একটা স্বভাবসুলভ বিষয় হলো মায়াময় কারুকার্য ভরা একটা অবয়ব;আরও, স্বামীর চোখে শূন্যতা যুক্ত হলে স্ত্রীর রূপ পবিত্র ফুলের মতো দেখায়। সন্নিবেশিত তানপুরা সুরে অতি মাদকতা ছড়ায়।
কবির শান্ত রইলো। শেষে কবির বিছানা ছেড়ে নেমে এসে সূচনার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠিক এমন একটা সময় এক্ষুনি আসুক ওদের দুজনেরই যেন চাওয়া ছিল। ওরা দু’জনেই শান্ত হয়ে চেয়ে রইলো আরও কিছুক্ষণ। মানুষের মন যা চায় তার পূর্ণ প্রাপ্তি হলো ঐ মহাশূন্যের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তের আনন্দের দোলা উদাসীন সুখে সুখী করে তুলে। সবকিছু কেমন যেন এক গভীর আনন্দে মিশে গিয়ে চাওয়া-পাওয়া তখন শূন্য হয়ে যায়। মনের মাঝে আর কোনো কল্পনার রস বেঁচে থাকে না। বরং বোবা অনুভূতি শ্রেষ্ঠ অনুভূতি লাগে তখন।
কবির সূচনাকে লক্ষ করে বললো-
চিনেছি দোয়ার খোলে যেমনটি চিনেছি ফুল;
তাই, হাসি মুখে অকাতরে বিনম্র চিত্ত হিল্লোল।
(০৬)
খুব করে একটা কবিতা শোনাতে ইচ্ছে করছে। এই পরিবেশে জীবনানন্দ হলেই বরং বেশি মানানসই হবে-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশােকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরাে দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতাে চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়ােজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখােমুখি বসিবার বনলতা সেন।
সূচনা উঠে দাঁড়ালো, বলল-
সজনি স্বয়ং যেখানে উপস্থিত, তখন ঐ দূরের চাঁদ-তারাকে ডেকে এনে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে হবে না।
-আমি যে শরীরী মানব; কিন্তু মন, সে তো বাঁধন ছাড়া! পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠতার দিকে ওর খেয়াল। আর এ কারণেই কখনো কখনো ঐ তারাকে খসে এনে খেপায়, চাঁদকে ছিঁড়ে এনে কপালে, সমুদ্রের নীল বিশালতা এনে বুকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে জাগে। সৃষ্টি জগতের রহস্য ঘেরা সৌন্দর্যকে উপমা না দিলে ঠিক হৃদয়ের ব্যাকুলতা, হৃদয়ের রং-কে প্রকাশ করা যায় না। হৃদয় তো চির যৌবনা আনন্দ মিছিল।
-বুঝেছি গো, বুঝেছি- লক্ষিটি,
তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি।
এবার-
ছেড়ে দাও গো ছেড়ে দাও দয়া করি,
রন্ধন কাজের বিঘ্নতা হেতু-
অফিস টাইম যাবে যে টুটি!
(০৭)
– একদিন উপোষ থাকলে এমন কি আসে যায়?
-জি জি!
-আচ্ছা সূচনা, আমাকে কি অনেক কিপটে মানুষ বলে মনে হয়?
-সে কথা লোকে জানে।
-লোকে যা জনার জানে, তুমি কি জনো সেটা বলো।
-আমার স্বামী বড্ড লক্ষ্মী।
-আবার পেঁচালে! সরাসরি বলো।
-আমি তো কখনো বলিনি যে তুমি কিপটে। তবে হ্যাঁ, তোমার মতো লোক ঢাকা শহরে যদি বেশি হতো, তাবে শহরের খাবার হোটেলগুলো বন্ধ হয়ে যেতো।
এ কথা বলা শেষ হতে না হতেই সূচনা দৌড়ে হেসে অন্য রুমে চলে গেলো। ঠিক জব্দ করার জন্য কবির তার পিছু নিলো। কবির রুমে গিয়ে সূচনার হাত ধরে টেনে কাছে এনে বললো- এমন সুন্দরী, সেই সাথে হাতের রান্নায় যাদু মাখা বউ আর ক‘জনের কপালে জুটে। আমি দামি কিছু কি কম দামে ছেড়ে দিবো? না কম দামি কিছু বেশি দাম দিয়ে নেবো? এতো বোকা নই!
কেমন যেন একটা সুখের হাসি সূচনার চোখের কোণ জুড়ে ভেসে উঠলো। সে হাসিতে একটা অহংকারের ক্ষীণচ্ছটা ফোটে উঠলো বটে, তবে তাতে বরং তার সৌন্দর্য আরও বেশি প্রকাশিত হলো।
রুমে থাকা ঘড়ির কাটা বলছে, এখন সময় সাতটা বেজে গিয়েছে। বাসা থেকে অফিস দূরত্ব ত্রিশ মিনিটের পথ।
-আজ তোমাকে ছুটি দেয়া হলো। চলো বাহিরে নাস্তা করি।
-সে কেন? রান্নার সব জোগাড় প্রায় শেষ। এখন চুলাতে তুলে দিলেই হয়ে যাবে। শুধু শুধু বাহিরে কেনো?
কবির সূচনাকে থামিয়ে দিয়ে বললো – স্ত্রীকে নিয়ে মাঝে মধ্যে পালাতে হয়।
সকলের অক্ষি পরে পড়ুক ধুলো,
সূর্যের মুখে ঘন কালো মেঘ;
পাখিদের দিয়েছি ছুটি, বাগান গিয়েছে লুটি
চুপি চুপি বেঁধে জুটি লুটেছে মন!
(০৮)
-সে বেলা, সে ক্ষণ যায় বুঝি লুটি?
কতদূর নেবে ওগো- কখন দেবে ছুটি!
-নিরালে, আবডালে যত ব্যথা গেঁথে আছে এ হৃদয়;
তার প্রতিটা ব্যাথা বেলা শেষে ফুটে উঠুক কোমল আঁচল রাঙি।
-তাই! তাই বুঝি! তবে লও, কোন দিগন্ত নির্জনে,
হেথা আমি হবো নীরব পদ্ম: তুমি ভ্রমর হয়ে গেও- গুনগুনি।
-তবে তাই হোক!
কবির স্ত্রী সূচনাকে প্ররোচনা দিয়ে বলল কিছুটা সেজে নিতে। সাজগোজ তো সাধারণতই হয়, তবে আজ একটু বাড়তি করে বলা- এই আর কি। সূচনা প্রথমে প্রয়োজনীয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলো। আর অন্যদিকে কবির গোসলখানায় প্রবেশ করলো।
স্ত্রী লোকের স্বাভাবিক গঠনটাই এমন যেন সে নিজেকে নিজের মনের মতো সাজিতে নিতে পারে। একজন কবি যেমন কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে একটা কবিতাকে সাজাতে পারেন, ঠিক তেমনি একজন স্ত্রীলোক তার নিজেকে সেভাবে সাজিয়ে নিতে পরেন। শেষে ঐ রূপালী চাঁদটাও স্ত্রীলোকের ঐ সৌন্দর্যের কাছে হার মেনে যায়। লজ্জা পেয়ে যায় শেষে।
কবির গোসল সেরে এসে দেখতে পেলো সূচনা আয়নার দ্বারে দাঁড়িয়ে ব্রাশের ছোঁয়ায় তার ঘন কালো চোখের পাঁপড়িগুলো তে মাশকারা লাগিয়ে চিরল করে তুলছে। তার এ রূপালী রূপ ঠিক খইয়ের আদলে মনোমুগ্ধ হয়ে ফোটে উঠছে।
কবির আরো খেয়াল করে দেখলো, তখন সময় সাড়ে সাতটা পেরিয়ে গিয়েছে। সূচনাকে কিছুটা নরম সুরে দ্রুত করার জন্য বলে অফিসে যাওয়ার সাহেবি পোষাক পড়ে নিলো। অফিস তো আর সুখ-দুঃখ-রশিকতা বুঝে না। তাই সকল কিছুর পেছনে অফিসের তাড়না তো থাকেই।
-হে অরণ্য হরিণী প্রিয়তমা আমার, শেষ হলো? (এই বলে সূচনার রুমে প্রবেশ করলো আবার।)
-জি বাঁশিওয়ালা। (এই বলে আয়নার থেকে মুখ সরিয়ে কবিরের দিকে সরে এলো।)
(০৯)
স্পষ্ট দু’টো চোখ। তার মুখাবয়বে আনন্দে দ্যুতি ছড়াল। ঈষৎ ভেজা চুলগুলো গোছানো। খয়েরি জামা। খয়েরি রঙ এর কানের দোল। সব মিলিয়ে যে স্পষ্ট রেখা এসে দাঁড়ালো তা বিদ্যুৎ রেখা হয়ে চমকে ওঠে কবিরের হৃদয় তরঙ্গখানি এলোমেলো হয়ে উঠল। কবির তার স্ত্রীর রূপে মুগ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পুলক জাগলো। সেই সাথে হৃদয়ে জমে ওঠা তরঙ্গগুলো চিৎকার করে বলে উঠলো
-সূচনা, তুমি আমার ভালোবাসা। হৃদয়ের সর্বস্ব জয়ী স্ত্রী।
-দেবী।
-বুঝিনি। (সূচনা, উত্তর কেটে মুখটা ওদিকটায় সরিয়ে নিলো)
-ফুল ফুটেছে বনে, বনের কি দায়?
রোদ হেসে উঠছে দিগন্তে,পাখি গাইছে বনে,
এলোমেলো রায়ু ধায়..হায়…
কি আশ্চর্য, কী অপূর্ব, নিখিল মাতুয়ারা রবির আলোয়,
যেন সব সাজাতে উষ্ণ অভ্যুত্থান গীতি তার।
-আর লাজ সইছে না কিন্তু! আমি কেঁদে দেবো। (বলে কবিরের সংস্পর্শ দূরে এসে দাঁড়ালো)।
যে পবিত্রতার দ্যুাতি আজি এইখানে ছড়ালো তা কবির হয়ত সারা জীবনের জন্য জীবিত করে রাখবে। আর এটাই স্বাভাবিক। গাঙচিলের ঠোঁটে করে ঘুরে বেড়ানো দূরের কোনো সুখ/ভালোবাসা নয়; এ প্রাণে প্রাণে ফোটে ওঠা সদ্য উপস্থিত সুখ/ভালোবাসা।
ওরা দু’জনে বেরিয়ে গেলো। রাস্তা থেকে একটা রিকশা নিয়ে নিলো। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় ইট পাথরের দালান। সুজা উপরের দিকে তাকালে চোখে পড়ছে আজকের দিনটা কতটা স্পষ্ট আলোয় ছাওয়া। আকাশের বুকটা নীল। নীরবতার আবহে মিতালী চলছে ওদের মাঝে।
-তখন অনার্স ১ম বর্ষে পড়ি। আমাদের মেসে এসে এক বড় ভাই স্ত্রীর সঙ্গ নিয়ে গল্প করতেছিলেন। হয় না এমন, নানান বিষয়ে এদিক-ওদিক আলাপচারিতা। মেস একটা স্বাধীন ভাব থাকেই।
সূচনার মুখে শুধু একটা হাসির আদল ভেসে উঠলো। সে হাসির কোনো শব্দ হলো না।
-তো সেই বড় ভাই, প্রেম-বিয়ে-সংসার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। সে সময় উনার কথা শোনে মনে হয়েছিল, জীবনে একটা নারী বন্ধুর খুব প্রয়োজন। স্ত্রীর প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, একজন ছেলের সাথে মেয়ের কিংবা মেয়ের সাথে ছেলের কখনো বন্ধু হতে পারে না।সে সময় মনে হয়েছিলো, বাবার যদি অনেক টাকা-পয়সা থাকতো, তাহলে স্ত্রীর আঁচল ছেড়ে কখনো বাহিরে যেতাম না। পৃথিবীর বুকে দিন হলে সূর্যের আলোতে, রাত এলে সূর্যের আলো ঘুরে চাঁদের বুকে পড়ে আবার পৃথিবীর বুকে এসে। অমাবস্যা এলে সূর্যের আলো পৃথিবীর ওপাশেই জেগে রয়। আমিও সূর্য হবো। কিন্তু, হায় আফসোস, খোদা না দিলেন টাকা বাবাকে, আর না দিলেন আমাকে।
(১০)
-নানান টানাপোড়নের মাঝে যে ক্ষীণ আলো আমাদের মাঝে যে উষ্ণতা ছড়ায় বরং তাই সুন্দর; এতটুকুই যথার্থ। বিশাল আকাশকে সুন্দর করতে এক টুকরো সাদা মেঘই যথেষ্ট, জনাব।
-হয়ত তাই। হয়ত জীবনের অপূর্ণতার সাথেই জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য বয়ে চলে।
-আমার মনে হয়, আমরা যেমন আছি তেমনই ভালো।
কবির সূচনার হাতটা অধিকার করে নিয়ে সম্মতিসূচক বলে উঠলো- হুম।
-ভেবে দ্যাখো, যদি অফিস আদালতে না যেতে তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াত! ঘর গোছানো, রান্না করা। তখনও নিজের মতো করে অবসার সময় কাটানো আর হয়ে উঠত না।
-তখন আমাদের ঘরটা একটা মঞ্চ হতো। ডাইনিং স্পেসটা হতো ধুলো উড়া মেঠো পথ। আবার কখনো সরু পিচঢালা পথ। এমনটাও ভাবা হতো, এ পথটা কোনো গভীর অরণ্যে প্রবেশ দ্বার, কিংবা সমুদ্রের পাড় বেয়ে চলা ঝাও ঘেরা শান্ত ছায়ায় হেঁটে চলা মেঠো পথ। কখনো ভাবা হতো, ধূসর মরুভূমির তপ্ত পথ। তখন আমাদের জানালায় এসে পড়ত নীল সমুদ্রে থেকে আছড়ে পড়া বাতাসের খোলা উদ্দামের চোট। সমুদ্রের বুক থেকে ছুটে আসা শীতল হাওয়া এসে তোমার শাড়িতে, আর আমার এই গায়ে পড়ে থাকা ঢোলা পাঞ্জাবিতে এসে ব্যগ্র হয়ে উড়তে চাইতো।
-আর রান্না ঘরটা?
-সে তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। তবে তুমি ভেবে নিতে পারো উসমানীয় সাম্রাজ্যের কিংবা সম্রাট শাহজাহানের রন্ধনশালার মতো দামি কিছু।
-এর কিছুর প্রয়োজন নাই। আমার রান্নার ঘর আমার মনের রাজাকে ঘেরা স্বপ্নময় শত ফোয়ারার আকর। সেখানে সবটা ঘিরে থাকবে আমার মনের মানুষের মনের কথা দিয়ে।
সূচনা আবার করিরের চোখে চোখ রেখে হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল- আমার কল্পনার যত রঙ তা তোমার মনের রঙে রাঙা।
খুব ছোট আওয়াজে আবার উচ্চারণ করলো- অনেক ভালোবাসি।
আবারও ক্ষীণ আওয়াজে বললো- প্রিয়।
কবির প্রত্যুত্তরে কোনো সাড়া দিলো না বটে, তবে তার চোখে-মুখে যে সৌন্দর্য প্রকাশ পেলো তা দিয়ে সূচন তার সারা জীবন সম্পদ করে রেখে দিলেও এতটুকুও অত্যুক্তি হবে না।
(১১)
এমন সময় কবিরের ফোনে কল এলো। হ্যাঁ-হুম বলে ছেড়ে দিলো। ওদের দু’জনের মাঝে নিরবতা ভাঙতে না ভাঙতেই খাবার হোটেলের সামনে এসে পৌঁছালো। রিকশা ভাড়া পরিশোধ করে সুজা হোটেলে প্রবেশ করে দু’তলায় উঠে গেলো। কবির যদিও জানতো যে, দু’তলায় খাবার পরিবেশনে সময় নষ্ট হয়, তবুও দু’তলাতেই যাওয়া। দু’তলায় কিছুটা মানুষের ভিড় কম আর বেশ সুসজ্জিত।
ওয়েটার নিজ থেকে আশার আগেই কবির ডেকে নিলো। ওরা মুখোমুখি বসলো। মেন্যু ঠিক করার জন্য কবির সূচনাকে এগিয়ে দিয়ে কয়েকটি স্পেশাল খাবারের কথা উল্লেখ করলো। সকাল বেলায় পরোটার সাথে কলিজা, খাসির পায়া ভালো লাগতে পারে। সূচনা খুব বিনয়ের সাথে কবিরের দিকে এগিয়ে দিলো বলল- তুমি দিয়ে দাও।
কবির হেসে বলল- আজ তুমি।
সূচনা কিছুটা ইতস্তত করে বলল- তুমি অর্ডার দাও। আমি তার সাথে যুক্ত করছি।
কবির ঈষৎ হেসে বলল- ঠিক আছে ম্যাম। আচ্ছা এমন হলে কেমন হয়, আইটেম বেশি নেই কিন্তু একই আইটেম একাধিক না নিই?
-ওকে জাহাঁপনা। আমি রাজি।
-জি জি।
ওয়েটারকে উদ্দেশ্য করে কবির- চারটা শাহী পরোটা। সাথে একটা ডাল-ভাজি মিক্সড। একটা কলিজা বুনা। দুইটা ডিম মামলেট।
-হোটেলে এসে ডিম ভাজি, হবে না।
-ম্যামের নিষেধ। স্যু মামলেট ব-আকার-দ বাদ।
-আরেকটা পরোটা বাড়িয়ে অর্ডার দিতে পারো।
এমন সময় আবার ফোন এলো। কবির পূর্বের ন্যায় আবার হ্যাঁ-হু-আচ্ছা-ঠিক আছে বলে ফোন কেটে দিল।
অতঃপর ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেল।
-সময় যে কেমন করে চলে যায়! বিশেষ করে সকাল বেলাটায়।
-এবার বুঝেছো শ্রদ্ধেয় বর আমার! প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে শুধু শুধু কৈফিয়ত চাওয়া।
(১২)
-সে তো কিছু রসে, আর কিছু বসে। জনো, অফিসে একদিন এক আংকেল এসে বলছিলেন, জানো কবির পৃথিবীর বুকে সবচে বড় ম্যাজিক কি? একই দেখো, কিছুক্ষণ আগেই সকাল হলো আর এখন বিকেল।
-ঠিক। মাঝে মধ্যেই প্রশ্ন জাগে, এখনই এতটা বেলা হয়েছে! অবাক হই।
-সময় সব সময়ই তরুণ। বাঁধন ছাড়া ঘোড়ার খুড়ে বসে শুধুই ছুটে চলে।
কবিরের ফোনে আবার কল এলো। কবিরের চোখ-মুখ চঞ্চল হয়ে উঠে। বিষয়টা বিশেষভাবে সূচনা চোখে পড়ে।
ফোন রিসিভ করার আগে হাত ঘড়িটার সময় দেখে নিলো। দেখলো আট টা বেঁজে গিয়েছে। কবির ফোন রিসিভ করে পূর্বের ন্যায় হ্যাঁ-হুম-জ্বি-ঠিক আছে বলে রেখে দিলো।
-প্রেমটুকু কোলাহলের জন্য জলচর মাছের মতো ডাঙ্গায় পড়ে ছটফট করে মরে যাচ্ছে। নির্জনতা একান্ত কাম্য। জানো সূচনা, ঠিক এজন্যই বসতবাড়ির কাছে অরণ্য থাকা প্রয়োজন। নদী থাকা প্রয়োজন। এই যাপিত ঘর-সংসারকে ছুটি দিয়ে খানিকটা সময় পালিয়ে কখনো অরণ্যে, কখনো নদীর পাড়ে বেড়িয়ে আসা গেলো। ছুটির দিনে দু’জনে হারিয়ে যাওয়া, কখনো মুখোমুখি বসে থাকা, ঐ দূর নীল আকাশে ছুটে চলা মেঘ দেখা, রাত্রিকালীন রূপালী চাঁদের মায়া উপভোগ করা গেলো। এ মুক্তির আনন্দ বার্তা বনবাদাড় ছাড়িয়ে সাত আসমান পেরিয়ে গেল।
-এখন যে নির্জনতায় আনন্দের কথা ভাবছ, তা আবার ক’দিন পরেই ফের চিৎকার করে বলবে, এক মুঠো কোলাহল দাও। আমি বরং বলি কি, ভিড় ঠেলে যতটুকু আপন করে পাওয়া যায় তাই প্রকৃত প্রেম, খাটি ভালোবাসা।
-এ কথা মানতে আপত্তি নেই জনাবা। আঁধার কেটে ওঠা ভোরের সূর্য কিংবা মেঘ কেটে ওঠে উঁকি দেওয়া চাঁদের আলো সত্যিই দারুণ।
-বরং দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে প্রিয়কে পাওয়া পরম আনন্দের; অতি পুণ্যের।
(১৩)
-রবি ঠাকুরের কবিতার খাতা থেকে দু’টো লাইন এখানে আওড়ালে মন্দ হয় না-
‘নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে,
তারি মধু কেন মনমধুপে খাওয়াও না?
নিত্য সভা বসে তোমার প্রাঙ্গণে,
তোমার ভৃত্যের সেই সভায় কেন গাওয়াও না?
ইতিমধ্যে ওয়েটা খাবার পরিবেশন শুরু করে দিলে। প্রথমে সূচনা, পরে কবির গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। যদিও তখন ওরা টেবিলের দুই পাশে বসেছিলো, কিন্তু এখন ওরা এক পাশে বসে নিল।
খাবার পরিবেশনে হোটেলগুলো বেশ সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। খাবারগুলোও বেশ সুস্বাদু।
আবার ফোনে কল এলো। ওপাশ থেকে কথা বলার এক পর্যায়ে উদ্বিগ্নের আওয়াজ ভেসে উঠল।
-শিট! কখন এসেছে? জি, কোথায় যাবেন, কিছু কি বলেছেন?
কথা বলা শেষ হলে কবিরের চোখ দু’টো আরও চঞ্চল হয়ে উঠলো।
-কোনো সমস্যা? কিছু কি হয়েছে?
-বস্ অফিসে এসে আমাকে খুঁজেছেন। কোথায় যেন নিয়ে যাবেন।
সূচনাকে উদ্দেশ্য করে কবির আবার বলল- ঠিক আছে। খেয়ে নাও।
সূচনা মনের দিক থেকে কিছুটা সংকোচ বোধ করলেও মুখের সৌন্দর্যকে এতটুকুও ম্লান হতে দেয় নি। সে পূর্বের ন্যায় কবিরের সাথে সঙ্গ দিয়ে চলল। ব্যস্ততা আর সময় সব সময় এক পথে অনুকূলে চলে না তা সূচনা স্পষ্টতই বুঝতে পেলো।
সময় তখন সাড়ে ন’টা পার হয়ে গেছে। খাওয়া প্রায় শেষ। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আদর মাখা অবশিষ্টাংশটুকুই প্লেটে অবশিষ্ট রয়েছে। কবির সূচনার প্লেটে খাসির পায়াসহ কিছুটা সুরা নামিয়ে দিল। সূচনা একবার-দু’বার বরণ করেও পার পেল না। কবিরের বিনয় আর তার সময়ের তাড়নার জন্য বেশি কথা না বাড়িয়ে তা নিতে হল।
মাংসল নয় কিন্তু পায়ার গোড়ার দিকে শক্ত তৈলাক্ত অংশটুকু সুরা দিয়ে খেতে বেশ লাগছিল। হঠাৎ করেই সূচনার হাত পিছলে জামার উপর পড়ল। খাসির পায়াতে থাকা সুরা জামার উপর ছড়ে পড়ল। এই দেখে কবিরের মুখ থেকে একটা বিরক্তিকর আওয়াজ ওঠে এল। তিক্ত চোখে তাকিয়ে সূচনাকে বলল- এটা কিছু হইল!
সূচনা বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। ওয়েটার দৌড়ে এল। সূচনা টিস্যু দিয়ে মুছে নিয়ে দাঁড়াল এবং সরে এসে ওয়াশ রুমে গেল। সাথে কবির হাত ধুতে গেল। হাত ধুয়ে এসে বসতে না বসতেই আবার ফোনে কল এল। এবার উত্তর কাটল শুধু- আচ্ছা!
কবির স্পষ্টতই বুঝতে পেল সূচনাকে এভাবে লজ্জায় ফেলা উচিত হয় নি। ও খুব মন খারাপ করেছে।
সূচনা ফিরে এলো। জামাতে হলদে দাগ পড়ে গিয়েছে।
(১৪)
কবিরের কথামতো ওয়েটার বিল নিয়ে এল। অতঃপর বিল ও ওয়েটারের বকশিশ পরিশোধ করে দিল।
কবির ও সূচনা উভয়েই স্বাভাবিক হতে চাচ্ছে কিন্তু ওদের মাঝে কোথায় যেন একটা জড়তা কাজ করছে। শেষে হোটেল ছেড়ে বাহিরে চলে এল।
-আমি রিকশা করে চলে যেতে পারবো। তুমি অফিসে চলে যাও। অফিসের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
কবিরের ইচ্ছে করছিল সূচনাকে বাসা অবধি এগিয়ে দিতে। কবির এগিয়ে গিয়ে বাসা পর্যন্ত রিকশা ঠিক করে ভাড়া পরিশোধ করে দিল। অতঃপর কবির সূচনার দিকে এগিয়ে গিয়ে সজল নয়নে তাকিয়ে লক্ষ্মী ছেলেটির মতো বলল- সরি, আসলে..।
কথা শেষ হতে না হতেই সূচনা কিছুটা খোঁচা দিয়ে উত্তর কাটল- এভাবে না আনলেই পারতে!
কবিরের মুখটা লজ্জায় কাল হয়ে গেল। সূচনা রিকশায় উঠে বসল। কবির মুখ ভার করে স্থানেই দাঁড়িয়ে রইল। রিকশা ছেড়ে দেবে এমন সময় সূচনা কবির কে ইশারা দিয়ে কাছে ডাকল। কবির শান্ত ভাবে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এদিকে সূচনা মুচকি হাসিতে হাসছে। আচমকাই সূচনা তার হাতের দুই আঙ্গুলি দিয়ে কবিরের নাক চেপে ধরে দোলিয়ে বলল- সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ।
কবির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যদিকে সূচনা রিকশা করে চলে গেলো। এতগুলো লুকের মাঝে স্ত্রীর হাতে হেনস্তার স্বীকার হয়ে লজ্জায় প্রায় মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম হয়ে উঠল বটে তবুও কবিরের মুখে ঐ প্রচ্ছন্ন হাসিটাকে কিছুতেই লুকানো পারলো না। লোক সকলের ভর্ৎসনা কিংবা কারো কারো প্রেমের রসিকতা ভরা চোখের আলোর কাছ থেকে সে হাসি আড়াল করা গেল না আর।
সূচনা হয়ত এতক্ষণে রিকশায় বসে বসে অন্তরের গহীন থেকে হাসির দ্যোতনা খইয়ের মতো ছটকে ছটকে পড়ে মরতে বসেছে…
–
ছোট গল্প: বনলতা ও আমি
তারিকুজ্জামান তনয়
এপ্রিল’২০২৫
শেওড়া পাড়া, ঢাকা